ঢাকা,  মঙ্গলবার  ০৭ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কী ও কেন?

প্রকাশিত: ১৬:১৬, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কী ও কেন?

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কী ও কেন?

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের অবিচ্ছেদ্য অংশে হিসেবে পরিণত হয়েছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এটি এখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবেও স্বীকৃত।

প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের আয়োজনে বৈশাখের শুরুর দিনে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের নানান বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হলেও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তা পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রশ্ন আসতে পারে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কী ও কেন?

সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বরা বলছেন, নামের মধ্যেই এর কারণ উল্লেখ আছে। সব অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে হয়ে থাকে এ শোভাযাত্রা।

১৯৮৬ সালে শোভাযাত্রা শুরুর দশম বছরে (১৯৯৬) আনন্দ শোভাযাত্রাটি নাম নেয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য়। কালের পরিক্রমায় আয়োজনটি সর্বমহলে এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পায় যে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য‘ হিসেবে এটিকে স্বীকৃতি দেয়। কারণ হিসেবে ইউনেসকো উল্লেখ করে, মঙ্গল শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।

 

মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছবি: অন্তর্জাল

শুরুতে ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা

শুরুতে শোভাযাত্রার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। প্রথমবার সেটির নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, নামটা মঙ্গল শোভাযাত্রা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও শুরুতে আনন্দ শোভাযাত্রাই বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই পরিচিত হয়। ১৯৯০ সালে ভাষাসৈনিক ইমদাদ হোসেন ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের পরামর্শে বর্ষবরণ শোভাযাত্রা নাম পাল্টে রাখা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।

প্রতি বছর শোভাযাত্রার অন্যতম অনুষঙ্গ থাকে বাঁশ ও কাগজের তৈরি নানান ভাস্কর্য। যা তৈরি হয় কোনও একটি প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে। লোকসংস্কৃতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ উপাদানগুলো বেছে নেওয়া হয় এই আয়োজনে। এতে যেসব উপকরণ থাকে সেসব বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী জিনিস—যেমন সোনারগাঁয়ের লোকজ খেলনা পুতুল, ময়মনসিংহের ট্যাপা পুতুল, নকশিপাখা, যাত্রার ঘোড়া, সুন্দরবনের বাঘ।

কেন মঙ্গল শোভাযাত্রা, কী তার বার্তা—জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা শব্দের মধ্যে তার বার্তা নিহিত আছে। মানুষ, সমাজ, দেশের মঙ্গল কামনায় যে যাত্রা সেটাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। সব অশুভকে পরাজিত করে মঙ্গলময় হোক সবকিছু।

শুরুটা যেমন ছিল

ইতিহাস বলছে, এর শুরু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই। তখন ১৯৮৫ সালে। সাম্প্রদায়িক সামরিক শাসনের রোষানলে তখন অমানিশা। শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গন নড়বড়ে হতে শুরু করেছে। বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে নেই তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। এমন পরিস্থিতিতে চারুপীঠের কর্মীরা অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আয়োজনের পরিকল্পনা করেন এবং শিল্পাঙ্গনকে আবারও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন।

সেই বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরির পর যশোরের রাজপথে বের করা হয় এক শোভাযাত্রা, যার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের অর্জন আর বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। এরপর চারুপীঠের কর্মীরা পহেলা বৈশাখেও তেমন একটি সর্বজনীন শোভাযাত্রা করার চিন্তা করেন এবং পরের বছর ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ হিসেবে প্রস্তুতি নেন। এরপর সেটি ছড়িয়ে পড়লো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও রাজধানীতে। ১৯৮৬ সালের পহেলা বৈশাখের ভোর ৬টায় বেজে ওঠা সানাই আর বাদ্যযন্ত্রের সুর, এখন সেটাও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রধান অনুষঙ্গ।

 

মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছবি: অন্তর্জাল

দেশ থেকে বিদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা

কেবল দেশে নয়, মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্বদরবারেও বাঙালিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কেবল বাংলাদেশি বাঙালি নন, বিশ্ব নাগরিকদের আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়েছে এই রঙিন আয়োজনটি। এর আয়োজনের ধরন দেখলেই আর বলে দিতে হয় না এটা বাংলা নববর্ষকে বরণের আয়োজন। পৃথিবীর যে প্রান্তে বাঙালিরা আছেন তারা চেষ্টা করেন ছোট করে হলেও একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করতে।

অবাক বিষয় হলো, ১৯৯৪ সালে নববর্ষের শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন ও বনগাঁ শহরে। এরপর বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দান অব্দি বিস্তৃত এই শোভাযাত্রা এখন বাংলার আয়োজনকে ভিন্নমাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছে।