ঢাকা,  মঙ্গলবার  ১৮ জুন ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

৬ জুন ৮ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ: মূল্যস্ফীতি হ্রাসই লক্ষ্য

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ১৮ মে ২০২৪

৬ জুন ৮ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ: মূল্যস্ফীতি হ্রাসই লক্ষ্য

ফাইল ছবি

নিত্যপণ্যের বাজারে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে নতুন বাজেটে দ্রব্যমূল্য কমানোর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর।

সর্বশেষ এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়েছে। এতে করে বেশিরভাগ নিত্যপণ্য বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। যেভাবেই হোক বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। ইতোমধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। আগামী ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

নতুন বাজেটে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতিফলন ঘটেছে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাধারণ মানুষ যাতে স্বস্তি পায় সে বিষয়গুলোতে বাজেটে জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের দাম যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে এনবিআর।   এ ছাড়া এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোনোভাবেই যাতে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম না বাড়ে সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কোটি পরিবারের হাতে সময়মতো টিসিবির পণ্য পৌঁছে দেওয়া, খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম চালু রাখা, ডিলারদের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ১৫ টাকায় চাল বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি (কাবিখা) ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাজেটে বিশেষ ঘোষণা থাকবে। নি¤œ আয়ের মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য দিতে টিসিবির কার্যক্রম আরও বাড়ানো হতে পারে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে, যা মার্চ মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ। এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২২ শতাংশের অর্থ হলো ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে, সেই একই পণ্য এই বছরের এপ্রিলে কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১১০ টাকা ২২ পয়সা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতীয়ভাবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। যদিও নতুন বাজেটে সরকার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি রাখতে চায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী নানামুখী সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া, ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের প্রভাব এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়েছে। দেশে ডলারের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এতে করে আমদানি খরচ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বজুড়েই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানেও মূল্যস্ফীতি বেশি। তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার ৬০ শতাংশের ওপর। তবে নতুন অর্থবছরে আমরা যে কোনো মূল্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমিয়ে বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। ফলে বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমবে বলে আশা করছি। শুধু তাই নয়, খাদ্য মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। টিসিবির মাধ্যমে বর্তমানে এক কোটি পরিবার যে কমমূল্যে খাদ্যপণ্য পাচ্ছে, সেখানে পরিবারসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্যসংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এদিকে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি অনুমোদন করেছে সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সেখানে দশটি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় নিয়ে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্র্মাণ, প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা, বাজেট ঘাটতি ধারণা পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমার গ্রাম আমার শহর পরিকল্পনা দ্রুত এগিয়ে নেওয়া, সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো, ডিজিটাল শিক্ষায় নজর, ফাস্ট-ট্র্যাক অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করায় বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার ৪.৬২ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রাও ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি অর্জনের গুরুত্ব কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকলেও আগামী অর্থবছরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা। এই খাতে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছেন তারা। অর্থনীতিবিদদের মতে, নতুন সরকারের সামনে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এরপর অস্থির ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনা। আর্থিক খাতের দুরবস্থা দূর করা, কর কাঠামো ঢেলে সাজানো, ঝিমিয়ে থাকা শেয়ারবাজারে গতি আনা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের সামনে অনেকগুলো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। দেশে এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। হুট করেই জাদুর কাঠি দিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না। অর্থনীতিতে এর পরের চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ডলার সংকট। ডলারের বাজার এখন রীতিমতো টালমাটাল। ডলারে শৃঙ্খলা না ফেরালে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে। 

এদিকে, ২০২৩ সাল জুড়েই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। এ কারণে সারা বছর দেশের নি¤œ আয়ের সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়েছে। নতুন বছরে এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই হবে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর বাইরে রিজার্ভের অস্বাভাবিক পতন, টালমাটাল ডলারের বাজার, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, সরকারি- বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে না পারা, সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়া এবং ঋণের সুদ পরিশোধ করাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। 

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে অর্থনীতির গলার কাঁটা ডলার সংকট। দফায় দফায় নানা পদক্ষেপেও ডলার-সংকট কাটাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো তা কমছেই। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। খোলা বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ডলার। ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাজেটে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন থাকা জরুরি। 

দেশের বিদ্যমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে খাদ্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সারের ওপর কর না বাড়াতে এনবিআরকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বর্তমানে কিছু খাদ্যপণ্য, খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ ও সারসহ কৃষি উপকরণ এবং শিল্পের কিছু মৌলিক কাঁচামাল শুল্ক-মুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই চাপে রয়েছে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ইতোমধ্যেই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনমূলক নীতির পথে হাঁটছে সরকার। যে কারণে চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার বাড়ছে খুব সামান্য।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছিল ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস পর্যন্ত অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো বেশ চাপে থাকায় সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট করে সম্প্রতি বাজেট সংশোধন করা হয়। প্রায় দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এবার একই উদ্দেশ্যে সরকারি ব্যয় কমানো হচ্ছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়িয়ে দরিদ্রদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাজেট প্রণয়নে।

সূত্র: জনকণ্ঠ