ঢাকা,  শনিবার  ১১ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ইতিহাসের পাতায় খলনায়ক জিয়া

প্রকাশিত: ১৫:৩২, ৭ নভেম্বর ২০২১

ইতিহাসের পাতায় খলনায়ক জিয়া

৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে বিএনপি, যা জাতির সঙ্গে একটা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেদিন কোনো বিপ্লব হয়নি, আর জনগণের সংহতির তো প্রশ্নই নেই। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল হুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল হায়দারসহ বহু সৈনিক ও অফিসারকে হত্যা করা হয়। বহু সৈনিক ও অফিসারদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে এইদিন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে এই হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়েই বিএনপি নামক দলটির জন্ম হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের উৎখাত করার লক্ষ্যে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান হয়; এবং অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে আটক করা হয়। কিন্তু তার আগেই মোশতাক-জিয়া চক্র বুঝতে পারে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জাতীয় চার নেতাই বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবে।

সে আশঙ্কা থেকে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের আগের রাতেই মীরজাফর মোশতাক গং জিয়া-ফারুক-রশিদরা রাতের অন্ধকারে মানব সভ্যতার ইতিহাসের আরেক জঘন্যতম বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরিকল্পিতভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে চার জাতীয় নেতা— বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়ে খন্দকার মোশতাককে গ্রেপ্তার করেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক-রশিদ-ডালিমরা থাইল্যান্ডে পালিয়ে যায়। কিন্তু জাসদ ও তাদের নেতা কর্নেল তাহেরের হঠকারী সিন্ধান্তে ৭ নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়াকে মুক্ত করে।

হত্যা করা হয় সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, সেক্টর কমান্ডার এটিএম হায়দার ও সাব-সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদাকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সেক্টর কমান্ডারও নিহত হননি। অথচ ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে শেরেবাংলা নগরে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে দুজন সেক্টর কমান্ডার, একজন সাব কমান্ডার ও ১৩ সেনা কর্মতর্তা নিহত হন। মূলত এই হত্যাকাণ্ডের পরই জিয়াউর রহমান এককভাবে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

৭ নভেম্বর বিএনপির জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন ও ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালন একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বিএনপি মূলত, এই দুটি দিবসে বিজয় উল্লাস করে থাকে। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বিএনপি ও স্বাধীনতার পরাজিত কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যারা জিয়াউর রহমানের কল্যাণে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে এমন কয়েকটি ক্ষুদ্র দল শুধু দিনটি পালন করে থাকে।

৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ছিল কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। কিন্তু পরবর্তী জেনারেল জিয়ার কূটকৌশলে কর্নেল তাহের ও জাসদ পরাজিত হয়। ক্ষমতার নিরঙ্কুশ অধিকারী হন জিয়াউর রহমান। যে অভ্যুত্থানের কারণে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন জিয়া, উল্টো সেই অভ্যুত্থানের দোষারোপে ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহের, মেজর জলিলসহ প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় জাসদ নেতৃবৃন্দ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই কথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে প্রাণদাতা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন জিয়াউর রহমান। অন্যদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সময় জিয়াউর রহমানকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন কর্নেল তাহের। বিএনপি ৭ নভেম্বরের ঘটনায় জিয়াউর রহমানকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও মূলত তিনি ছিলেন বিশ্বাসঘাতক এবং একজন খলনায়ক।

১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের চরিত্রটাই বদলে দেয়। এই অভ্যুত্থানের নামে বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় দীর্ঘ অবৈধ সেনা শাসনের ভিত রচিত হয়। জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায় । ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি!

নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, অবৈধ উপায়ে একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন,গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হ্যাঁ-না ভোট করা, সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তুলে দেয়া, রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু, তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সেনাকর্মকর্তা হত্যা ও হাজার হাজার সেনা সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়।

খুনিদের নিরাপত্তা দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা, জেলহত্যা বিচারের তদন্ত স্থগিত করা, বিনা কারণে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে ঢুকিয়ে দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া, যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান ও রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। শাহ আজিজের মতো যুদ্ধাপরাধীকে প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াসহ এমন সব অপকর্ম করেছেন যাতে বাংলাদেশ কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও আদর্শের পরিপন্থি।

জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসক, অবৈধ রাষ্ট্রপতি। তিনি নিজের ক্ষমতার স্বার্থের জন্য আইনের তোয়াক্কা না করে এক একটি অবৈধ সামরিক ফরমান জারি করতেন। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত কেউ নির্বাচন কিংবা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিজেকে একক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করে ‘হ্যাঁ কিংবা না’ ভোটের তামাশার নির্বাচন করেন। আবার ১৯৭৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি দলটি প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি ছিলেন সেনাপ্রধান। নির্বাচন কিংবা দল গঠন সবই ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও আইনের বরখেলাপ। যা রাষ্টদ্রোহিতারও শামিল।

৭ নভেম্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই ঘটনায় লাভবান হয়েছে শুধু জিয়াউর রহমান ও উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। আর পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তাক্ত ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এই দিন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন।

দীর্ঘদিন জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিপ্লব ও সংহতির নামে একটি মিথ্যা আজগুবি তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মানুষ এখন সঠিক তথ্য পাচ্ছে। মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না। বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমানকে আর নায়ক বানানো যাবে না, বাঙালির ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী খলনায়ক হিসেবে স্থান পাবে।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন