ঢাকা,  শনিবার  ১৮ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ

আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি ৭০ কোটি ডলার মিলবে জুনে

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ৫ মে ২০২৪

আপডেট: ২০:২৩, ৫ মে ২০২৪

আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি ৭০ কোটি ডলার মিলবে জুনে

ফাইল ছবি

বেশিরভাগ শর্ত পূরণ হওয়ায় আগামী জুন মাসে আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি প্রায় ৭০ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সংকটের এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এই অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে। অবকাঠামো খাত উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় আইএমএফ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করা হবে।

তৃতীয় কিস্তির জন্য যেসব বিষয়ে সংস্কার করতে হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-করছাড় কমিয়ে কর আদায় বৃদ্ধি করা, রিজার্ভ বাড়ানো, আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়, বিদ্যুৎসহ সকল খাতে ভর্তুকি যৌক্তিক করার কৌশল নির্ধারণ এবং খেলাপি ঋণ কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ ছাড়া রিজার্ভের ঘাটতিও খুব বেশি নয়, তাই ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেতে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক নানা সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি এখন কঠিন সময় পার করেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক বর্তমানে নিম্নমুখী। বিশেষ করে রপ্তানি ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অর্থনীতি। প্রতিনিয়ত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কমছে রিজার্ভ। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে নিত্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে দেশে। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের দাম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকটের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সৃষ্ট সংকট এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবলভাবে চেপে বসেছে। নতুন করে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ আরেকটি সংকট তৈরি করেছে বিশ্বজুড়ে। এ অবস্থায় আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে। ওয়াশিংটন সফরের আগে সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আশা প্রকাশ করে জানান, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাংলাদেশ পাবে।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের কিস্তিগুলো পাওয়া যাওয়ায় একদিকে যেমন ডলার সংকট দূর হচ্ছে, অন্যদিকে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে সারাবিশ্বে। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবেই সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণের কিস্তি পাবে। এদেশের উন্নয়নে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আইএমএফ।

এ অবস্থায় বড় চার উন্নয়ন সহযোগী বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বিনিয়োগ ও অবকাঠামো খাতে ঋণ সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের জন্য গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিপালনের জন্য মোটা দাগে যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছাড়া অন্য সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট, ঋণ কর্মসূচির আওতায় শর্ত বাস্তবায়ন ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় আসে আইএমএফের একটি মিশন।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সঙ্গে তাদের টানা ১৬ দিনের সিরিজ বৈঠক চলবে আগামী ৮ মে পর্যন্ত। ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়ার আগে আইএমএফের পক্ষ থেকে ওইদিন ঋণের তৃতীয় কিস্তি প্রদানে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আইএমএফ ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। উল্লেখ্য, আইএমএফ গত বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিনদিন পর প্রথম কিস্তিতে ছাড় করে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।

এর পর গত ১৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড় করা হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুন মাসে তৃতীয় কিস্তির প্রায় ৭০ কোটি ডলার ছাড় করা হতে পারে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেওয়ার কথা। এদিকে, প্রাথমিকভাবে আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে নীট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রিজার্ভে বড় ধরনের উন্নয়নের উন্নতি না হওয়ায় বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়। তারপরও বাংলাদেশ এ লক্ষ্য থেকে ৫৮ মিলিয়ন ডলার পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য গত জুন পর্যন্ত রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। তখনো লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হয়নি। জুন শেষে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন। 
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আইএমএফের ঋণের বড় ১০টি শর্তের মধ্যে ৯টি পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তাই ঋণের পরবর্তী কিস্তি  পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। ইতোমধ্যে তৃতীয় কিস্তির জন্য নির্ধারিত ছয়টি পরিমাণগত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রিজার্ভ ছাড়া পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে কর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।

সরকার ইতোমধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কর রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ১৬৪  কোটি টাকা। এ ছাড়া ঋণের আরেকটি শর্ত হলো বাজেট ঘাটতি যেন ৯০ হাজার ৫২০ কোটি টাকার বেশি না হয়। ডিসেম্বরে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঋণের দুটি শর্ত হলো, ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের সামাজিক ব্যয় ও মূলধন বিনিয়োগ হতে হবে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার এ দুই খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

এ ছাড়া গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারকে দেওয়া রিজার্ভ মানি লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়েছে। এ ছাড়া তৃতীয় কিস্তির জন্য আইএমএফের কিছু কাঠামোগত শর্তও ছিল। এ শর্ত পূরণে এরই মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপির ত্রৈমাসিক তথ্য প্রকাশ করা শুরু করেছে। সংসদে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন এবং ফিন্যান্স কোম্পানি আইন পাস হয়েছে এবং আইএমএফের সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনগুলো এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকার মার্চ মাসে পেট্রোলিয়াম পণ্যগুলোর জন্য একটি পর্যায়ক্রমিক সূত্র-ভিত্তিক মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং এরই মধ্যে দুবার সমন্বয় করেছে।

বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এ বিষয়টি বাস্তবায়নেও সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যে কয়েক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে ৩৩টি শিল্প খাতের কর অবকাশ তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এসব শিল্প খাত ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন হারে কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে।