ঢাকা,  সোমবার  ০৬ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

সোব্বাসীরাই কি ঢাকার আদি জনগোষ্ঠী, কী তাদের পরিচয়?

প্রকাশিত: ১৬:১০, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

আপডেট: ১৬:১২, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সোব্বাসীরাই কি ঢাকার আদি জনগোষ্ঠী, কী তাদের পরিচয়?

সোব্বাসীরাই কি ঢাকার আদি জনগোষ্ঠী, কী তাদের পরিচয়?

সোব্বাসী একটি ঢাকাইয়া গোষ্ঠী, তারা সোব্বাস ভাষায় কথা বলে। তারা সুবেদার ইসলাম খাঁ’র আমলে ঢাকায় এসে স্থানীয়দের সঙ্গে বসতি গড়ে তুলে। এরাই কি তাহলে আদি ঢাকাইয়া? ঢাকাইয়া সংস্কৃতি বলতে আমরা যেসব আচার অনুষ্ঠানকে জানি, এসব আদতে সোব্বাসীদের সংস্কৃতি বলেও দাবি সোব্বাসী গবেষকদের।

সোব্বাস শব্দটি এসেছে সুখবাস থেকে। ঢাকাইয়ারা সুখকে বলে ‘সোখ’। সুখে বাস করে বলে তাদের সুখবাস বলা হয়। সুখবাস থেকে সোখবাস, তা থেকে সোব্বাস। অর্থাৎ, সুখবাস> সোখবাস> সোববাস> সোব্বাস> সোব্বাসী।

সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় এসেছিলেন বিরাট বহর নিয়ে। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়, ইরান-আরবি ও আফগান লোকজনও ছিল বহরে। সুবেদারের লোক বলে তাদের ঠাটবাট ও পয়সাকড়িও ছিল বেশ। এরা নিজেদের সোব্বাস বা অভিজাত শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ধারণা করা হয়, সুখে বসবাস করে বলেই তাদের নাম সোব্বাসী। এরা বিভিন্ন ভূখণ্ড থেকে এ অঞ্চলে এসেছিল বলে তাদের ভাষা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। নিজেদের মধ্যে তারা নিজের ভাষাতে কথা বললেও, বাইরের কথা বলতো সাধারণ এক ভাষায়। সে ভাষাটি ছিল ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষা। ভাষাটি এসেছে খারিবুলি ভাষা থেকে। ভারতবর্ষের দরবারে তখন খারিবুলি ভাষাতেই কথা বলতে হতো। এ ভাষাটাই যখন বাইরে ছড়িয়ে গেল তা তখন হয়ে গেল হিন্দুস্তানি ভাষা। তবে এ ভাষার কোনো লিখিতরূপ ছিল না। লেখার ভাষা ছিল কেবলই ফারসি।

সোব্বাসী ভাষাটি মূলত ১৪টি ভাষার মিশ্রিত রূপ। এ ভাষার ৬০ শতাংশই সংস্কৃত-বাংলা শব্দ। হিন্দুস্থানি ভাষা যখন এ অঞ্চলে আসে তখন সেটা সংস্কৃত দ্বারা প্রভাবিত হওয়া শুরু করে। আজকের আর ১৮ শতকের বাংলা ভাষার মধ্যে যেমন অনেক তফাৎ, সেভাবে তখনকার হিন্দুস্তানি ভাষা ও আজকের হিন্দুস্তানি (কথ্য সোব্বাসী) ভাষাতেও অনেক তফাৎ। কুট্টিদের সঙ্গে সোব্বাসীদের বড় পার্থক্য এ অঞ্চলে তাদের আগমনকাল। ১৬১০ থেকে সোব্বাসীদের এ অঞ্চলে বসবাস। অন্যদিকে কুট্টিরা এসেছে ১৭৭০সালের পর। তবে সোব্বাসী পুরোনো হলেও স্বীকৃতিতে এগিয়ে কুট্টি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাটনা, ঊড়িষ্যা, বিহার থেকে অসংখ্য মানুষ এদেশে প্রবেশ করে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। এই উর্দুর সঙ্গেও অনেকে সোব্বাসীদের গুলিয়ে ফেলে।

হেকিম হাবিবুর রহমান, সৈয়দ তৈফুরের ভাষ্যে, ঢাকার অধিবাসীগণ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এক শ্রেণি ‘কুট্টি’ অন্য শ্রেণি ‘সুখবাসী/সোব্বাসী’। সোব্বাসীরা কোথাও চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করে না। কথা বলে খুব দ্রুত। যেমন শেখ সাহেব বাজারকে বলে সিক্সাসাববাজার, রায় সাহেব বাজারকে বলে রাসাবাজার। শাহাবুদ্দিন সাবুর রচনায় ২০২১ সালে বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি নামে একটি অভিধান বের হয়েছে। অভিধানে বাংলা শব্দভুক্তি রয়েছে মোট ১৫ হাজার ৩০৪টি। এটিই সোব্বাসী ভাষার একমাত্র অভিধান।

ঢাকাইয়া সংস্কৃতি বলতে আমরা যেসব আচার-অনুষ্ঠান জানি, এসব আদতে সোব্বাসীদের সংস্কৃতি। শবে বরাতে প্রতিবেশীদের মাঝে হালুয়া-মাংস বিতরণ, সেহরির সময় কাসিদা পাঠ করে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানো, কাওয়ালি, ঈদের মিছিল, বিয়েতে বাড়িতে মহিলাদের বিয়ের গীত গাওয়া; এ প্রথাগুলো সোব্বাসীদের থেকেই ছড়িয়েছে অন্য অঞ্চলে। এমনকি কুট্টিদের পোশাক হিসেবে টিভি নাটকে যে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি দেখানো হয়, তা সোব্বাসীদেরই পোশাক। তারা সুবেদারের বিভিন্ন বিভাগের পদে কর্মরত ছিল। পরে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। বর্তমানেও তারা চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য দুভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছে।

কিছু বইয়ে খোশবাস এবং সুখবাসদের এক ধরা হলেও, সোখবাস আর খোশবাস সম্পূর্ণ আলাদা দুটি গোষ্ঠী। খোশবাসরা শিয়া এবং উর্দুভাষী। সোব্বাসীরা তা নয়। হেকিম হাবিবুর রহমান ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে বইয়েও দুটোকে আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সোব্বাসী ভাষা চর্চাকারীর সংখ্যা লক্ষাধিক হবে না। তবে এখনো এ ভাষায় কথা বলতে পারে ছয়-সাত লাখ মানুষ।

নবাব আব্দুল গণির নবাবী খেতাব পাওয়া উপলক্ষে ১৮৭৫ সালের পর প্রতিবছর ১ জানুয়ারি শাহবাগে সোব্বাসদের সর্বজনীন উৎসব হতো। তাওয়ায়েফদের নৃত্যগীত ছাড়াও হোলির গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গজল, কাওয়ালি, ঢোল, তবলা, লাউনি (একদল অন্যদলের গানের প্রত্যুত্তর দিত), মিরাসি (বিয়ে, সুন্নতে খাতনা, নাক-কান ছেদানী, সাতোয়াসায় পেশাদার নারী গায়িকা ভাড়া করে আনা হতো) প্রভৃতি সামাজিক সঙ্গীতচর্চায় অভ্যস্ত ছিল তারা। চৈত্র-সংক্রান্তি, মেলা, জন্মাষ্টমীতেও হিন্দু-মুসলমান সোব্বাসীরা হিন্দুস্থানি ভাষায় সঙ্গীত পরিবেশন করতো।

শুরু থেকে এখনো বেশিরভাগ সোব্বাসী পুরান ঢাকাতেই বাস করছে। গুটিকয়েক বাদে পুরান ঢাকার বাইরে যাননি কেউ। মাত্র ৫টি থানা জুড়ে তাদের বসবাস। ধোলাইখাল থেকে শুরু করে চাংখারপুল, হাজারীবাগ, আমলীগোলা, সাত মসজিদ রোড, বুড়িগঙ্গা বেল্ট এটুকুতেই আছে তারা। বর্তমানে ঢাকায় সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার ও লালবাগ থানার অন্তর্গত বিভিন্ন মহল্লায় তাদের বাস।

তথ্যসূত্র:
ক। ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে, হেকিম হাবিবুর রহমান
খ। ঢাকা পাঠ, আনিস আহমেদ 
গ। দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, রাফিয়া মাহমুদ প্রাত