ঢাকা,  রোববার  ০৫ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

লালন মেলা

ভক্তকূলে সেজেছে আঁখড়া

প্রকাশিত: ১১:৩৯, ১৯ অক্টোবর ২০২৩

ভক্তকূলে সেজেছে আঁখড়া

.

লালন  শাহ ১৭ অক্টোবর ১৭৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থেকে তিনি নানান গুনে গুণান্বিত হয়েছেন। তিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত।‌ তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক।

লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তার গান উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন।

তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার সময়ে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

নানা কুসংস্কারকে তিনি তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ।‌সেজন্য লালনের সেই সংগ্রামে বহু শিষ্ট ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়েছিলেন । তাই তার স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতি বছর দুইবার লালন মেলার আয়োজন করা হয়। একবার দোল পূর্ণিমা উৎসবের সময় এবং আরেকবার বাংলা পহেলা কার্তিকে।

প্রতি বছর এই মেলায় অংশগ্রহণ করে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার দর্শনার্থী। নানা পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে। তবে ভক্তরা অংশগ্রহণ করে লালনের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই মেলাকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া সদর এলাকায় থাকে উপচে পড়া ভিড়। কুষ্টিয়ার লাহিনী থেকে বড়বাজার পর্যন্ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২২ সালে লালনের মাজারে প্রায় ১০ লাখ মানুষ এসেছিলেন। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক ছিলেন প্রায় পাঁচ লাখ।

এছাড়াও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম রাকিবের নেতৃত্বে একটা জরিপ করে জানা যায়, কোনো কোনো লালন ভক্ত বিগত ৪০ বছর ধরে এ মেলায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। আবার কোনো ভক্তকে দেখা গেছে বিশ বছর ধরে আঁখড়াতেই পড়ে আছেন।

লালন মেলা শুধু দর্শনীয় স্থান নয়, এখানে নানা পেশা-ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনস্থল। পর্যটন খাতে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময়ী স্থান হিসেবে দেখা যাচ্ছে মেলাকে। একটা গবেষণা থেকে জানা যায় যে , ২০২২ সালে লালনের মাজারের আয় ছিল প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাজারের টোল থেকে আয় হয়েছিল প্রায় এক কোটি টাকা, মেলার আয় হয়েছিল প্রায় তিন কোটি টাকা এবং দান থেকে আয় হয়েছিল প্রায় এক কোটি টাকা।

লালনের পুরুষ ভক্তের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে নারী ভক্তরাও। রাতদিন লালনের গানে মুখরিত থাকে আঁখড়া। সাধুসঙ্গরা গোল হয়ে বসে বাদ্যযন্ত্র দিয়ে লালনের গানের সুরকে আরও মুখরিত করে। দর্শনার্থীরা আনন্দের সঙ্গে লালনের গান উপভোগ করে এবং লালনের গানের অর্থ বোঝার চেষ্টা করে।

দেশ-বিদেশে নানা শিল্পীও এখানে গান করতে আসেন। তারা গানের মাধ্যমে লালনের নিজস্বতা ফুটিয়ে তুলতে চান। অনেকেই তো আবার এই গানকে ধারণ করে নিজের জীবন পরিচালনা করেন।

লালন দেশি-বিদেশি ভক্তদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের একটা আবেগের স্থান। সাঁইজির মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর গড়ে ওঠে শতশত দোকান। নানা পদের খাবারের পাশাপাশি বাহারি দ্রব্যের পসরা সাজায় দোকানীরা। বাউল গান ও ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত খাবারগুলোর প্রতি আলাদা চাহিদা থাকে ভক্তদের। বাংলাদেশের চারু ও কারুশিল্প এবং কাঠের তৈরি নানা দ্রব্য মেলায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। দর্শনার্থীরা স্মৃতিরক্ষার্থে কিছু না কিছু ক্রয় করেই।

সর্বোপরি লালন এক আত্মিক বিষয়। লালনকে বুঝতে হলে আত্মায় ধারণ করতে হবে । অন্তরে লালন করতে হবে এবং মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে লালনকে পরিপূর্ণ বোঝা যাবে।


লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,‌ কুষ্টিয়া