ঢাকা,  শুক্রবার  ২৬ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ইসলামে পাত্রী দেখার পদ্ধতি ও নিয়ম : পর্ব ১

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২১ জানুয়ারি ২০২১

ইসলামে পাত্রী দেখার পদ্ধতি ও নিয়ম : পর্ব ১

বিয়ে শাদি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিবাহের বিষয়টি আমাদের সমাজে একটি কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের পরিবারেই এ বিষয়টি নিয়ে আগুন জ্বলছে। কেমন যেনো আমাদের হাত বাধা। আর আমরা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছি। প্রচলিত নিয়মে আমরা চলে আসছি। যতই সহজ করার চেষ্টা করছি সমাজ আমাদের ততই কঠিন বাগডোরে বেধে ফেলছে। আমরা এর থেকে বের হতেও পারছি না। অতএব, বিয়ের বিষয়ে জটিলতা কাটাতে সর্বপ্রথম সমাজের মুরব্বিদের এগিয়ে আসতে হবে।

এ জাতীয় পরিস্থিতিতে এই অবৈধ সামাজিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ হলো ঈমানী শক্তি ব্যবহার করা। সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণের চেতনা হৃদয়ে জাগ্রত করা। হজরত রাসূলে কারিম (সা.) এর জীবনে এগারোটি বিবাহের কথা পাওয়া যায়। রাসূল (সা.) এই এগারোজন নারীকে বিবাহ করেছেন। তাদের মধ্যে নয়জন স্ত্রী রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের সময় জীবিত ছিলেন। আর দু’জন স্ত্রী রাসূল (সা.) এর জীবত কালেই ইন্তেকাল করেন। অর্থাৎ হজরত খাদিজা (রা.) ও উম্মুল মাসাকিন হজরত জয়নব বিনতে খুযাইমা (রা.)।

এ ছাড়াও আরো দু'জন নারী আছেন যাদেরকে রাসূল (সা.) বিবাহ করেছেন কি না এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে। তবে ঐতিহাসিকগণ সম্মত হন যে, তাদের কে রাসূল (সা.) এর কাছে প্রেরণ করা হয়নি। রাসূল (সা.) এর বেশিরভাগ স্ত্রী বিধবা ও বয়স্কা ছিলেন। আরবে সেসময় বয়স্কা ও বিধবাদের বিবাহ প্রচলিত ছিলো। 

ঐতিহাসিকদের মতে, বেশিরভাগ বিবাহ বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে ঐক্য  ও সম্প্রীতি গড়া বা তাদের সম্মান জানাবার লক্ষ্যে হয়েছিলো। তাদের বেশিরভাগই বয়স্কা ঝিলেন। সুতরাং বহুবিবাহের জন্য যারা নবী কারিম (সা.) কে অভিযুক্ত করেন তাদের যুক্তি অবৈধ হয়ে যায়। এর মধ্যে কেবল হজরত খাদিজা ও হজরত মারিয়া (রা.) এর সন্তান ছিলো। এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের সামনে নবী কারিম (সা.) এর বিয়ের অনুপম দৃষ্টান্ত বিদ্যমান থাকা। আমাদের সমাজ ও ঘরে ঘরে সেগুলো আলোচনা করা হয়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার মাধ্যমেই সামাজিক এ কুপ্রথাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মনে করি। 

সর্বোপরি এধরণের দুর্দশা থেকে মুক্তির উপায় চিন্তা করে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বিবাহ আপনার। আপনিই যদি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। আপনি যদি হুমকি দেন, এভাবে না হলে আমি বিয়ে করবো না। তবে প্রত্যেককেই আপনার হুমকির সামনে মাথা নত করতে হবে। আর বিয়ে যদি অন্যের হয় তবে তাদেরকে হেকমত ও সুকৌশলে সুন্নাতি বিবাহের দিকে আকৃষ্ট করুন। 

যদি তারা না মানে তবে আপনি তাদের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না। মনে রাখবেন, সমস্ত সমস্যা একবারে দূর হবে না। ধীরে ধীরে এই সমস্ত সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব। তবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।  আল্লাহকে বলতে হবে, হে আল্লাহ! আপনিই আমাকে সাহায্য করেন? আমাকে শক্তি দেন। আস্তে আস্তে সবকিছু পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া একান্ত জরুরি। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আপনাকে এ ক্ষেত্রে সাহায্য করবেন।

সামাজিক প্রথা সংস্কারে সাধারণ শর্তাবলি
এটি সত্য যে, প্রতিটি রীতি-নীতিই মন্দ বা অবৈধ নয়। তবে প্রত্যেকে ঐ সামাজিক রীতি-নীতি যা সওয়াব মনে করে করা হয় তা নাজায়েজ। সামাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতি থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে তৎসংশ্লিষ্ট কয়েকটি জিনিস জেনে রাখা প্রয়েজন।

১. বিয়ের অনুষ্ঠানে সব ধরণের ফটো ও ভিডিও করা থেকে বিরত থাকা। 
২. বিবাহ অনুষ্ঠানে বেপর্দা চলাফেরা যেনো না হয়।
৩. বিবাহের কোনো পর্যায়ে পুরুষ নারীর মেলা মেশা অনুচিত।
৪. জোর করে বা মনে কষ্ট নিয়ে বিয়ের কোনো পর্যায়ে কোনো কাজ না করা। 
৫. বিয়ের কোনো পর্যায়ে কোনো জিনিসের লেনদেন করা থেকে বিরত থাকা। 
৬. লোক দেখানোর জন্য কোনো কিছু করা যাবে না। 
৭. খাবারে অপচয় করা যাবে না। 
৮. কোনো জিনিসের অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা। 
৯. কোনো ধরণের ঋণ বা সুদি ঋণ থেকে বিরত থাকা। 

আজকের নিবন্ধটির বিষয় হলো, শরিয়তে বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোন ধরণের মেয়ে ও তার বৈশিষ্ট্য কী থাকবে? সে বিষয়ে। এ কাজটি বিয়ের একদম প্রধান একটি কাজ। এ আলোচনার পর আস্তে আস্তে আমরা আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ। 

শরিয়তের দৃষ্টিতে কনে কেমন হওয়া চাই?
হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারিম (সা.) বলেছেন, ‌নারীদেরকে চারটি জিনিসের জন্য বিয়ে করা হয়। ১. সম্পদের জন্য। ২. বংশের জন্য। ৩. সৌন্দর্যের জন্য। ৪. দীনদারীর জন্য। অতএব দীনদারকেই অগ্রাধিকার দাও। তোমারা সফল হয়ে যাবে। (বুখারি: ৪৮০২ )

আবু উমামাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলতেন, কোনো মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর ভীতির পর উত্তম যা লাভ করে তা হলো পুণ্যময়ী স্ত্রী। স্বামী তাকে কোনো নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে, সে তার দিকে তাকালে (তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও প্রফুল্লতা) তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হেফাজত করে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৮৫৭)

ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন তোমাদের কাছে এমন ব্যক্তির বিয়ের সংবাদ আসে, যার দ্বীনদারি ও চরিত্র তোমার পছন্দ। তাকে বিয়ে করো। চাই সে যেই হোক না কেনো। তুমি যদি এমন করো, পৃথিবীর মধ্যে প্রচুর ফেতনা ফাসাদ কলহের সৃষ্টি হবে। (মুসান্নিফে ইবনে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস: ১০৩২৫।

পবিত্র কোরআন ও অনেক হাদিসের আলোকে সুখী জীবনের জন্য যে নারীকে বিয়ের জন্য নির্বাচন করা আবশ্যক। সে হবে ফরহেজগার, মুত্তাকি। পবিত্র, সম্ভ্রান্ত ও বাড়ির সীমানায় বাস করা অনৈতিকতা থেকে বেঁচে থাকা নারী। পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করা থেকে বিরত থাকা নারী। একজন সতীসাধি কুমারী নারী। যার ঈমান ও আমলের প্রতি প্রবল ঝোঁক রয়েছে। এমন নারী, যে সর্বাস্থায় আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকে। এমন নারী, যে তার স্বামীর সম্মান, সম্পদ ও জীবন রক্ষা করেন। এমন নারী, যে বেশি বেশি মেহনত করতে পারে ও বেশি সন্তান দানের যোগ্যতা রাখে। কুমারী নারীকে বিয়ে করা। 

কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত এই গুণাবলী আলোচনা করে একটি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। যেনো প্রত্যেক পিতা তার কন্যাদের এভাবে শিক্ষা দেয়। এ গুণাবলী অর্জনের জন্য ঘরের পরিবেশও সেরকমভাবে তৈরি করে। ঘরে নিয়মিত তালিমের ব্যবস্থা করবে। আর সন্তানদের দ্বীনি মাদরাসায় পাঠায়।

কনে দেখার সময় করণীয়  
কোনো কনে দেখতে যাওয়ার আগে অবশ্যই ইস্তেখারা করে যাবে। এরপর এলাকার মানুষের কাছ থেকে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। তার চরিত্র, আদব-কায়দা, চাল-চলন ও দ্বীনদারী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে। যদি এতে সন্তুষ্ট হওয়া যায়, তখন বাবা-মা, বড় ভাই বোনদের কনে দেখতে পাঠাবে। এজন্য বড়সর অনুষ্ঠান করে খাওয়া-দাওয়া, তাদের বাড়িতে বিভিন্ন জিনিস নেয়ার কোনো দরকার নেই।

এ কারণে পরে নাযুক পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রত্যেক কনের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কনেকে নিয়ে চিন্তিত থাকে। তাদের কাছে বিয়ের কথা বলে কনে দেখে বাতিল করে দেয়া এটা অনেক কঠিন একটা বিষয়। পছন্দ অপছন্দের বিষয়টি খুব শালিনতার সঙ্গে বুদ্ধি বিবেচনা করে জানিয়ে দেয়া উচিত। সরাসরি কোনো সিদ্ধান্তে গেলে তারা কষ্ট পেতে পারে সেটা অবশ্যই খেয়াল করা উচিৎ। 

কনে পছন্দ না হলে দোষারূপ না করা 
বেশিরভাগ মানুষকে দেখা যায়, মেয়ে পছন্দ না হলে তাদের দোষ ইত্যাদি বলে কেটে পড়ার চেষ্টা করে। পছন্দ নাই হতে পারে। তাই বলে তাদের দোষারূপ করা, তাদের নানান বিষয়ে কটাক্ষ করা এটা অনেক বড় গুনাহ। এসব নিন্দনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আর অপছন্দ হলে নিজেদের বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সরে আসতে হবে। তাদের কোনো দোষ বর্ণনা করে আপনি চলে আসবেন এটা অনুচিত। 

কনেকে এক নজর দেখা 
যদি কোনো মেয়েকে বিয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়, তখন তাকে এক নজর দেখা জায়েজ আছে। কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বাণী থেকে এটা বুঝা যায়। তবে কীভাবে দেখবে, সে তরিকা কোথাও সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে লজ্জা ও শালিনতার মানদণ্ডে শরিয়াকে সামনে রেখে এক নজর দেখা যেতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, কনে দেখা এটা ছেলের জন্য আবশ্যকীয় কোনো বিষয় নয়। 

যদি মেয়ের পরিবার এতে রাজি থাকে তো সহজে বিষয়টি সেরে নিতে হবে। আর যদি মেয়ের পরিবার এতে রাজি না থাকে, তাদের সঙ্গে জোড়াজুড়ি, ঝগড়া-ঝাটি করা যাবে না। তখন ছেলের পরিবারের কোনো অভিজ্ঞ নারী মেয়ের বর্ণনা ছেলের কাছে বলবে। এতে যদি সে সন্তুষ্ট হয়, তাহলে বিয়ের দিকে আগাবেন। আর যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে তাদের কাছে নিজেদের উজর পেশ করবে। 

তাদের কোনো দোষ দেয়া যাবে না। এটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা উচিত। শরিয়ত কিছু বিষয় বিবেচনা করে মেয়েকে বিবাহের আগে একবার দেখার অনুমতি দিয়েছে। হ্যাঁ, তবে এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা, যেমন একটি পার্টির আয়োজন করা। মেয়েকে সুন্দর করে সাজানো। পার্লারে নিয়ে যাওয়া। তারপর ছেলের সামনে উপস্থিত করা। এসব শরিয়ত সমর্থন করে না। অবশ্যই এসব বিষয় পরিহার করতে হবে। যাই হোক, এ ক্ষেত্রে কোনো মেয়ে যদি সাধারণ পরিচ্ছন্ন কাপড়, অলঙ্কারাদি পরিধান করেন, যেগুলো তিনি সবসময় ব্যবহার করেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। 

এছাড়াও এ বিয়ের উদ্দেশ্যে মেয়েটির কোনো ছবি ছেলের পরিবারকে দেয়া ঠিক নয়। কারণ ছবি দেয়ার ক্ষেত্রে ছেলে ছাড়াও অন্য কোনো গায়রে মাহরাম দেখে ফেলার আশঙ্কা থাকে। অযথা ছেলের ছবি চাওয়াও ঠিক হবে না। যদি মেয়ে বাড়ি গিয়ে দেখতে সমস্যা হয়, তাহলে ছবি ইত্যাদি না পাঠিয়ে স্কাইপি, ইমু ইত্যাদি ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমেও এক নজর দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চলবে...

গাজীপুর কথা