ঢাকা,  সোমবার  ২৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

পাহাড়ের জীবনে সমতলের স্বাচ্ছন্দ্য

প্রকাশিত: ১৩:০৩, ১৭ আগস্ট ২০২৩

পাহাড়ের জীবনে সমতলের স্বাচ্ছন্দ্য

খাগড়াছড়ির রামগড়ে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু। এর ওপারে ভারত, এপারে বাংলাদেশ। সম্প্রতি তোলা।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও সমতলের মানুষের জীবনে বর্তমানে আর তেমন কোনো ফারাক লক্ষ করা যায় না। সড়ক ও শিক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নয়নে এই পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী মানুষের জীবনধারা অনেকটা পাল্টে গেছে। পাহাড়ের কঠিন জীবন হয়েছে অনেকটা সহজ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সূচকেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটন ঘিরে বর্তমানে সেখানকার অর্থনীতির চাকা বেশ সচল।
পাহাড়ের জীবনে সমতলের স্বাচ্ছন্দ্যউদ্বোধনের অপেক্ষায় জেলার একমাত্র রামগড় স্থলবন্দর। বন্দরটি উদ্বোধন হলে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।

আবার পার্বত্য অঞ্চলকে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে নির্মাণ করা হচ্ছে সীমান্ত সড়ক।
খাগড়াছড়ি জেলার প্রতিটি এলাকা এখনো নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের আওতায় না এলেও সদর ও উপজেলা শহরের প্রতিটি সরকারি অফিসে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট। এসব এলাকার সাধারণ মানুষও ব্যবহার করতে পারছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। সরেজমিনে গত ২৩ ও ২৪ জুলাই খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পার্বত্য এই জেলার এসব উন্নয়ন চিত্র।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ‘খাগড়াছড়ি জেলায় সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই জেলায় ৫৯টি পাকা সড়ক নির্মাণ করেছে। আর আগামী এক মাসের মধ্যে রামগড় স্থলবন্দর চালু হয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পণ্য আনা-নেওয়া আরো সহজ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে।

এই জেলায় পর্যটন খাতেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আলুটিলা পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে অ্যাম্ফিথিয়েটার। ছুটির দিনগুলোয় সেখানে সাত থেকে আট হাজার পর্যটক আসছে।’

সহিদুজ্জামান আরো বলেন, ‘পর্যটন ঘিরে পরিবহন ও হোটেল-মোটেল ব্যবসা অনেক বেড়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে কৃষির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বর্তমানে এখানকার ফলমূল রপ্তানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন বেশ স্পষ্ট।’

সড়ক ও জনপথ সূত্রে জানা গেছে, ২১০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন সড়কে পিসি গার্ডার সেতু, আরসিসি সেতু ও আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়ির সড়ক বিভাগ এ কাজ সম্পন্ন করেছে। খাগড়াছড়িতে সড়ক উন্নয়নে এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাজ।

বর্তমান সরকারের আমলে ৯২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি-জালিয়াপাড়া সড়কের সিন্দুকছড়ি থেকে মহালছড়ি পর্যন্ত সড়ক। এটি বাস্তবায়ন করেছে সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি। ১৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ছয়টি সড়ক নির্মাণ উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। ৮৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঘাইহাট-মাচালং-সাজেক সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। দীঘিনালা-ছোটমেরুং-চাংড়াছড়ি-লংগদু সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ৩৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে। পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে দীঘিনালা-মারিশ্যা সড়কের অবশিষ্ট কাজ শেষ করা হয়েছে। এসব সড়ক নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনীর ১৯ ইসিবি। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলাকে এক সড়কে সংযুক্ত করতে বর্তমান সরকার এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার সীমান্তে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হচ্ছে এই সড়ক। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

শিক্ষা-স্বাস্থ্যে উন্নয়ন

খাগড়াছড়িতে গত এক দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরাও এসেছে শিক্ষার আওতায়। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এ জেলায় ৪০টি মাধ্যমিক স্কুল ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০। শিক্ষকের সংখ্যা ৩৯৮ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১০৫। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এ জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ৬৬ হাজার, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৮৯ হাজার।

খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি, রামগড়, দীঘিনালা ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালটি ১০০ থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট করা হচ্ছে। রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় সেখানে বসবাসকারীরা বর্তমানে সহজে চিকিৎসাসেবা নিতে হাসপাতালে আসতে পারছে।

জানতে চাইলে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব মিয়া বলেন, সিন্দুকছড়ি এলাকায় নতুন রাস্তা হয়েছে। এতে খাগড়াছড়ি এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা পাল্টে গেছে। এলাকায় অনেকে সরকারি ঘর (আশ্রয়ণ প্রকল্প) পেয়েছে। ছোট ছোট কালভার্ট হয়েছে।

খাগড়াছড়ির পংখী মুড়া এলাকার বাসিন্দা টিটং ত্রিপুরা বলেন, আগে সহজে স্কুলে যাওয়া যেত না। সিন্দুকছড়ির এই রাস্তা ছিল না। তখন খুব কষ্ট হতো। এখন সহজে গাড়িতে করে স্কুলে যেতে পারি।

মাটিরাঙ্গা উপজেলার দলিয়া এলাকার বাসিন্দা শিয়াংশু মারমা বলেন, কেউ অসুস্থ হলে আগে সহজে হাসপাতালে নেওয়া যেত না। রাস্তা হওয়ায় এখন রোগীদের সহজে স্বল্প সময়ে ডাক্তারের কাছে নেওয়া যায়। এর চেয়ে বড় উন্নয়ন আর কী লাগে!

রামগড় স্থলবন্দর পাল্টে দেবে সীমান্তের চিত্র

আশা করা হচ্ছে, খাগড়াছড়ি জেলায় গড়ে ওঠা রামগড় স্থলবন্দর পার্বত্য চট্টগ্রাসহ দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দেবে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে ভারতের সঙ্গে পণ্য আনা-নেওয়া আরো সহজ হবে। কমবে পরিবহন ব্যয়ও।

খাগড়াছড়ি সদরে ফোর পয়েন্টস ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক শওকত বাহারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি বদলে গেছে। এখানে নতুন নতুন অনেক রেস্টুরেন্ট হয়েছে। দিন দিন পর্যটকও বাড়ছে।