ঢাকা,  শুক্রবার  ২৬ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

গাজীপুরে মাংস বণ্টনের ১৫০ বছরের ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ১৮:২৫, ২১ জুলাই ২০২১

গাজীপুরে মাংস বণ্টনের ১৫০ বছরের ঐতিহ্য

গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জনবহুল গ্রাম ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া। ঈদুল আজহার পশু কোরবানির পর থেকে এ গ্রামে চলে মাংস ভাগাভাগির কাজ। গ্রামটিতে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে চলছে সামাজিক কোরবানির মাংস তৈরি ও বিতরণের কাজ। 

স্থানীয় ধনি-গরিব সবাই এই মাংসের অংশীদার। কোরবানি দেওয়া পশুর মাংস ভাগ তৈরি করে বিকেলের মধ্যে বিতরণ শেষ করা হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর রীতি পালিত হয়ে আসছে।

আয়োজকরা জানান, একদল স্বেচ্ছাসেবক পুরো কাজটি পরিচালনা করেন। শুরুতে তালিকা তৈরি ও তালিকা অনুযায়ী ঈদের আগের দিন প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে টোকেন পৌঁছে দেওয়া হয়। ঈদের দিন দুপুরে থেকে গ্রামের মানুষের কোরবানি করা মাংস ঈদগাহ মাঠে আসতে থাকে। পরে সেই জমাকৃত মাংস বণ্টন শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবকরা। টোকেন জমা রেখে বিকেলের মধ্যেই সমস্ত মংস বিতরণ শেষ করা হয়। গ্রামের বিধবা ও প্রতিবন্ধিদের জন্যও বরাদ্দ রাখা হয়। বহু পুরনো এই প্রথাটি এই গ্রামের দেখা দেখি এখন আশপামের অনেকেই পালন করছেন।

ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া গ্রামের কলেজ শিক্ষার্থী ইমন মিয়া বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছায় সাত বন্ধু মিলে সামাজিক এই মাংস বণ্টনের কাজ করছি। বণ্টন শেষে এলাকার মুরুব্বি ও বড় ভাইদের সহযোগীতায় গ্রামের সবাইকে মাংস বিতরণ করা হয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কাজটি আমাদের সমাজের একটি সামাজিক বন্ধন। এইদিন সবাই একত্র হয়। সবাইকে এক সঙ্গে পেয়ে খুব ভাললাগে। এক সময় আমাদের বড় ভাইরা এই দায়িত্ব পালন করতেন। এখন সেই দায়িত্ব আমাদের হাতে। একদিন হয়তো একই দায়িত্ব আমাদের ছোট ভাইরা পালন করবে।’

গ্রামের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন সরকার জানান, ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া গ্রামে যারা পশু কোরবানি দেন, তারা প্রতিটি পশুর মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ জমা দেন এই সামাজিক ভাগ-বণ্টনে। এই সমাজভুক্ত প্রত্যেকের বাড়ির জন্য একজন করে ভাগীদার ধরে মাংস ভাগ করা হয়। এবার প্রায় তিনশ’ ভাগ করা হয়েছে সামাজিক কোরবানির মাংস। স্থানীয় মসজিদ থেকে মাইকিং করে আওতাভুক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ডেকে এনে মাংস বিতরণ করা হয়।

ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি রফিজ উদ্দিন জানান, বাংলাদেশে অনেক গ্রাম আছে, যেখানে কোরবানি হয় মসজিদ কমিটির মাধ্যমে। কোরবানির মাংস যেন সমাজের সবার ঘরে পৌঁছায় সে জন্য কোরবানির মাংস তিন ভাগের এক ভাগ মসজিদ চত্বরে জমা করতে বলা হয়। জমাকৃত মাংস মসজিদের আওতাভুক্ত প্রতিটি পরিবারকে একক ধরে ভাগ করা হয়। ধনি-গরিব সবাই সমান হারে ভাগ পায়। এই নিয়মে কোরবানির মাংস বণ্টন করার ফলে কেউ মাংস পাওয়া থেকে বাদ যায় না।

তিনি বলেন, ‘এক সময় আমাদের বাপ-চাচারা এই দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের হাত ধরে আমরা করেছি। এখন সামাজিক এই মাংস বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে আমাদেরই ভাই-ভাতিজারা। একদিন তাদের হাত ধরে আরেক প্রজন্ম পালন করবে বহু বছরের পুরনো এই প্রথাটি। এইভাবে প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো এই রীতি আমরা টিকিয়ে রেখেছি।’

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘এই রীতিটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। তবে হালে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভাগ হয়ে ছোট পরিবার হয়ে যাওয়ায় সামাজিক কোরবানির এই মাংস ভাগের প্রথা দিন দিন কমে আসছে। সেই ক্ষেত্রে ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া গ্রাম মুরুব্বি, তরুণ-যুবকরা এই প্রথাটিকে টিকিয়ে রেখেছে যা সত্যি প্রশংসার দাবিদার।’

ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মো. ছাফায়েত উল্ল্যাহ জানান, কোরআন হাদিসের আলোকে সামাজিক এই রীতিটি সত্যি অন্যরকম। এখানে ধনি-গরিব সবার মাঝে সমানভাবে মাংস বিতরণ করা হয়। তাছাড়া প্রতিবন্ধি ও বিধবাদের জন্যও রাখা হয় আলাদা বরাদ্দ। এই প্রথাটি প্রজন্মের হাত ধরে প্রজন্মে টিকে থাকুক এটাই প্রত্যাশা।

গাজীপুর কথা