ঢাকা,  শনিবার  ২৭ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

বালুচরী শাড়ির রহস্যময় ইতিহাস

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

বালুচরী শাড়ির রহস্যময় ইতিহাস

বালুচরী শাড়ির রহস্যময় ইতিহাস

১৭০২ সালের দিকে বাংলার নাজিমের সঙ্গে দ্বন্দ হওয়ার কারণ ভাগীরথীর তীরে মকসুদাবাদে ঢাকা থেকে ভারতে চলে যান সম্রাট আরঙ্গজেবের দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান। তার নামে জায়গার নাম হয়ে গেল মুর্শিদাবাদ।

নিজেই শুধু গেলেন না পরিবারের সদস্য এবংতার পোশাক তৈরির কারিগরদেরও নিয়ে গেলেন। তাদেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সেই তাঁতী সম্প্রদায়কে থাকবার জন্য গঙ্গার তীরে একটি বালুকাময় গ্রাম দিয়ে দিলেন । বালু থেকে এলাকার নাম হয় বালুচর। কারো কারো মতে, এই জায়গাটির নামই জিয়াগঞ্জ।

মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খান তার বেগমদের পরার জন্য নতুন শাড়ি তৈরির আদেশ দিলেন সেই তাঁতিদের। তাঁতিরা রেশম সুতায় যে নতুন শাড়ি বুনলেন, তার নামই হল বালুচরী।

 

বালুচরী

বালুচরী

নবাবের বেগমদের জন্য যে শাড়ি বোনা হল, তা কিন্তু গল্প বলত। কিসের আবার? নবাবের শৌর্য্য স্থান পেয়েছে নকশায়। যেমন: ঢাল-তরোয়াল-হাতি-ঘোড়া-যোদ্ধা, হুঁকো পানের দৃশ্য। নানা অঙ্গভঙ্গিতে অন্দরমহলের নারী। রেশমের কাপড়ে রেশমের সুতায় ফুটে উঠতে থাকল এসব ছবি। এই হল বালুচরীর শুরু। বালুচরের এই তাঁতিরাই বংশানুক্রমে বুনতে লাগল বালুচরী।

একবার বন্যায় গঙ্গার স্রোতে তলিয়ে গেল তাদের গ্রাম। মলভূমের রাজারা তাদের আশ্রয় দিল। বিষ্ণুপুরে স্থাপিত হলো তাদের নতুন নিবাস। বিষ্ণুপুর শিল্পে বেশ সমৃদ্ধ। এখানের সব মন্দিরে আছে পোড়া মাটির অপূর্ব সব কারুকাজ। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ সব মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ । এই সকল কারুকাজ তাঁতিদের আকৃষ্ট করল খুব। ফলে শাড়ির নকশায় আসল আমূল পরিবর্তন। শাড়িতে শোভা পেতে লাগল কৃষ্ণলীলা, রাম লক্ষ্মণ সীতা, অর্জুন-দ্রৌপদী। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে লাগল বালুচরী। বণিকদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল বালুচরী সিল্ক।

তবে একসময় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কালের গহ্বরে হারাতে থাকল এর জৌলুস। বালুচরী ফেরাতে অগ্রণী হলে ঠাকুর পরিবারের উত্তরসূরি সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (সুভো ঠাকুর)।

 

‘স্বর্ণচরী শাড়ি`

‘স্বর্ণচরী শাড়ি'

কলকাতার হস্তশিল্প দফতরের রিজিওনাল ডিজাইন সেন্টারের অধিকর্তা ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শুভো ঠাকুর। তিনি বালুচর গ্রামে অনুসন্ধান চালিয়ে বালুচরী শাড়ির একটি আঁচলা উদ্ধার করেন। ওই সেন্টারে তখন নকশা-শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন বিষ্ণুপুরের তাঁত শিল্পী অক্ষয় দাস। শুভো ঠাকুরের নির্দেশে ওই আঁচলের নকশা করেন অক্ষয়বাবু। নতুন ভাবে তৈরি হয় বালুচরী শাড়ি। কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরে ফিরে এলাকার বস্ত্র ব্যবসায়ী ভগবানদাস সারদার আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালে অক্ষয়বাবু ফের শুরু করেন বালুচরী শাড়ির পুনর্বয়ন। বিষ্ণুপুরে শুরু হয় বালুচরী শাড়ির পথচলা। একে একে বিষ্ণুপুরের ঘরে ঘরে তাঁতশালে শুরু হয় বালুচরীর বুনন। পরের তিন দশকে এই শহরে ১০০০-র বেশি তাঁতে বালুচরী তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়ে।

হাল ফ্যাশনে প্রবীণ শিল্পী গুরুদাস লক্ষণ শাড়িতে সোনালি সুতার জরির কাজ যোগ করে তৈরি করেন ‘স্বর্ণচরী শাড়ি' । এ শাড়ির আছে আবার নানা ধরন ধারণ। বেশ ক বছর আগে অমিত লক্ষ্মণ চারণকবি বৈদ্যনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘রূপশালি মেয়ে’র চালচিত্র বালুচরীতে ফুটিয়ে তুলে হইচই ফেলেছেন তার ‘রূপশালি বালুচরী’ শাড়ি বাজারে নামিয়ে। ফুল পাতার নকশা দিয়ে আর সাঁওতাল লোকনৃত্যের দৃশ্যে গড়েছেন মধুমালতি নামের বালুচরী। টিভি সিরিয়ালের দ্রৌপদীর সাজসজ্জা মিলিয়ে শাড়িতে ফুটিয়েছেন অভিনব কায়দায় 'দ্রৌপদী শাড়িতে'। 

বালুচরী মোটামুটি তিন রকম:

●রেশমি বালুচরী - একরঙের রেশমি সুতো দিয়ে পুরো নকশা করা

●মীনাকারী - ভিন্ন ভিন্ন রঙের সুতোয় কাজ করা

●স্বর্ণচরী - সোনালি বা রুপালি রঙের সুতোয় কাজ করা

বালুচরী দৈর্ঘ্যে ১৫ ফুট লম্বা ও ৪২ ইঞ্চি চওড়া। আঁচলের দৈর্ঘ্য ২৪ থেকে ৩২ ইঞ্চি।গবেষিকা চিত্রা দেব বালুচরীর অলংকরণকে চার ভাগে ভাগ করেছেন, যথা চিত্র, কল্কা, পাড় ও বুটি। তার মতে চিত্র অংশের নকশা অন্যান্য শাড়ীতে দেখা যায় না। 

সাধারণ যে কোনো শাড়ি হতে, এর আঁচল বেশ খানিকটা লম্বাই হয়। কারণ শাড়ির মূল নকশা মানের আসল ছবির প্রেক্ষাপট আঁচলেই থাকে।

নকশা ধারা:
মূল চরিত্র বা একটা বিরাট আকৃতির ফুলের ঝাড় আঁচলের মাঝ বরাবর থাকে। তাকে ঘিরে উপরে নিচে অনেকগুলি আড়াআড়ি রেখা থাকে। এর সাথে থাকে কয়েকটি রো। রো গুলো সমান্তরাল থাকে। মানে এই রো গুলোর মধ্যে ছোট বক্সে বক্সে যেছবি গুলো থাকে , তা উপরে নিচে একই। পাশাপাশি বক্সের ছবিও এক। শাড়ির দুই পাশের পাড়ের নকশার মিল থাকে। শাড়ির জমিনে মধ্যে মধ্যে কিছু কল্কা দেখা যায়।

তথ্যসূত্র: বালুচরী শাড়ি - উইকিপিডিয়া, নকশা বদলে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই বালুচরীর, 
মুর্শিদকুলী খান - বাংলাপিডিয়া