ঢাকা,  মঙ্গলবার  ৩০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

৩৯ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকেন রফিকুল

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৫ আগস্ট ২০২৩

৩৯ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকেন রফিকুল

নিজের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবির সামনে রফিকুল ইসলাম

লম্বা দাড়ি আর পরনে সাদামাটা পোশাকে প্রথম দেখায় কেউ বিশ্বাস করবেন না, তিনি ছবি আঁকেন। এটা তার ৩৯ বছরের নেশা। তার আঁকা ছবি হয়তো খুব একটা শিল্পোত্তীর্ণ নয়। কিন্তু একটা মানুষের প্রতিকৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানসপটে এঁকে দেওয়ার অদম্য যে বাসনা, যে যুক্তি, যে দর্শন; তা হয়তো অনেক বোধসম্পন্ন মানুষের মধ্যে নেই। অন্যরকম এক ভাবনা ও দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

বলছিলাম রফিকুল ইসলামের কথা। একসময় পেশায় রিকশাচালক হিসেবে পরিচিতি মিললেও এখন তিনি ছবির ফেরিওয়ালা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধ্যানে-জ্ঞানে। এ কারণে প্রায় ৩৯ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলো ছড়াতে রং তুলি হাতে রফিকুল ছুটছেন স্কুলকলেজ আর পাড়া-মহল্লায়। দেয়াল অঙ্কনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছেন স্বাধীনতার মহান স্থপতিসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিচ্ছবি ।

পেশায় রফিকুল ইসলাম একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ভ্যানে করে মসলা জাতীয় খাবার বিক্রি করেন। করোনাকালে তিনি রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। তেষট্টি বছর বয়সে পা রেখেছেন রফিকুল। কিন্তু বয়সের কাছে হার মানেননি তিনি।

ছবি আঁকছেন রফিকুল ইসলাম

একসময় মাইলের পর মাইল রিকশা হাঁকিয়ে বেড়ানো ফিকুল এখন ছুটে বেড়ান ছবির ফেরিওয়ালার বেশে। তবে ব্যবসার চেয়ে তার কাছে আঁকাআঁকি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সুযোগ পেলেই রং তুলির ছোঁয়ায় দেয়ালে ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ছবি।

রফিকুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। তখন তার বয়স এগারো। পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় যুদ্ধে যেতে পারেননি। সেই আক্ষেপ তাকে এখনো তাড়া করছে। তাই টগবগে তারুণ্যে তিনি শুরু করেছিলেন নতুন যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলো ছড়াতে রং তুলি হাতে তুলে নেন। ছুটে বেড়ান স্কুলকলেজ আর পাড়া-মহল্লায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন প্রজন্মের মানসপটে গেঁথে দিয়েছেন তার শৈল্পিক চিন্তা চেতনায়।  

বঙ্গবন্ধুভক্ত এই রফিকুল ইসলামের বাড়ি রংপুর মহানগরীর তাজহাট বাবুপাড়া এলাকায়। ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ওই এলাকার বটতলায় প্রথম দেয়াল অঙ্কন করেন তিনি। রং তুলির আঁচড়ে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যা দৃষ্টি কেড়েছিল স্থানীয় যুবসমাজের। ওই দিন রফিকুল ইসলামের আঁকা ছবির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন স্থানীয় সমাজসেবক ও বর্তমান কাউন্সিলর ইঞ্জিনিয়ার শাহাদত হোসেন।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে এই ছবিটি আঁকেন রফিকুল ইসলাম

রফিকুল ইসলামের দেয়াল অঙ্কনে বাংলাদেশের মানচিত্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া, জাতীয় চার নেতা ও সাত বীরশ্রেষ্ঠও স্থান পেয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি তাঁর মনমগজ রপ্ত। দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেড় হাজারের বেশি ছবি এঁকেছেন তিনি। স্কুলকলেজ, মাদ্রাসা, রাস্তার ধারে বাউন্ডারি ওয়াল, যেখানেই ফাঁকা দেখেন, দাঁড়িয়ে যান তিনি প্রিয় নেতার ছবি আঁকতে। এ জন্য কারও কাছে টাকা নেন না রফিকুল।

শুধু ছবি আঁকাতেই থেমে নেই রফিকুল। দেয়াল অঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে নিজ উদ্যোগে স্কুলকলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, ঈদগাহ মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাড়ে ৫০০ কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা রোপণ করেছেন। এসবে তার জীবিকার বন্দোবস্ত না হলেও তিনি ছবি আঁকেন শুধুই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য।

রংপুর মহানগরীর তাজহাট বাবুপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম। স্ত্রী রশিদা বেগম, দুই মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে তার পরিবার। ছেলে-মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে আছেন রফিকুল ইসলাম। তবে কখনো কখনো ছোট্ট ব্যবসায় পুঁজির সংকট হলে উপার্জিত অর্থে সংসার চালাতে তাকে হিমশিমও খেতে হয়।

দেয়ালে এভাবেই ছবি আঁকেন রফিকুল ইসলাম

রফিকুল জানান, ১৯৮০ সালের দিকে তিনি রিকশা চালানো শুরু করে। পাশাপাশি ১৯৮৩ সালে অবসর সময়ে ছাপাখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। দীর্ঘ ১৬ বছরে রংপুরের ছকিনা প্রেস, ছাপাঘর, নিপুন, দৈনিক দাবানল ও দৈনিক পরিবেশে প্রেস শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। ওই সময় থেকে তিনি কাগজে, আর্ট পেপারে স্কেচ করে ছবি আঁকা শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে দেয়ালে দেয়ালে শুরু করেন রং তুলির আঁচড়ে ছবি আঁকা।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ঘটানোর লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে স্বহস্তে ছবি আঁকা শুরু করেছি। সবমিলিয়ে ১ হাজার ৫০০ ছবি আঁকা হয়েছে। ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে নিজ খরচে কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রায় সাড়ে ৫০০ চারাও রোপণ করেছি।

বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে চলার কারণ কী- জানতে চাইলে দার্শনিক ভঙ্গিতে বলেন, দ্যাখেন বঙ্গবন্ধু এই দেশটা স্বাধীন করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন থেকে বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে। তাদের কারণে আমরা কিন্তু আমাদের বিকাশ ঘটাইতে পারছিলাম না। দেশটা স্বাধীন হইলেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কারণে তিনি এই দেশটা যেভাবে গড়ে তুলতে চাইছিলেন, তা তিনি পারেননি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর কিন্তু তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। আর সে কারণে মনে করেছি- বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মুখটা মুছে গেলে তার আদর্শ মুছে যাবে। তার আদর্শ, তার দর্শন ছাড়া এ দেশের উন্নয়ন হবে না। এই চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকি।

রফিকুলের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি

রফিকুল সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দর্শনীয় স্থানে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকার পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৯ সালের জুনে কাঁধে রংতুলির পোটলা, হাতে জাতীয় পতাকা ও গলায় বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়ে রংপুর থেকে পায়ে হেঁটে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়া পৌঁছতে তার ৫৬ দিন লেগেছিল। এই সময়ে তিনি জেলা ও উপজেলা সদরে অবস্থান করে বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কন করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি রফিকুলের ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। এই ভালোবাসার গল্প বলতে গিয়ে কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়েন রফিকুল। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, ৬৪ জেলায় ছবি আঁকা শেষ করে পায়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকতে আঁকতে মক্কা যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার।

শিশু শিক্ষা বই দিয়েই তার লেখাপড়া শুরু এবং শেষ। তার ছবি আঁকার কোনো শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। নেওয়ার সুযোগও হয়নি। এখন রং তুলি সঙ্গেই থাকে। সুযোগ ও সময় পেলেই বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকেন, যেন তার ক্যানভাসে শুধুই বঙ্গবন্ধু।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইঞ্জিনিয়ার শাহাদত হোসেন জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এঁকে জীবনের ৩৮টি বছর পার করে দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। আমাদের তাজহাট এলাকার মানুষের কাছে তিনি সম্মানিত। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দর্শনীয় স্থানে দেড় সহস্রাধিকের বেশিও ছবি এঁকেছেন। এসবের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবিই তার রং তুলিতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে আমরা অভিভূত।