ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ০৯ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

প্রত্যেক মুসলিম দেশেই ভাস্কর্যের অস্তিত্ব আছে

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৪ নভেম্বর ২০২০

প্রত্যেক মুসলিম দেশেই ভাস্কর্যের অস্তিত্ব আছে

আমাদের দেশের ইসলামিক গ্রুপ ও দলগুলো সাধারণতঃ ইরান, পাকিস্থান, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইত্যাদি দেশকে আদর্শ হিসেবে দরে থাকে তাদের ইসলামী শাসনব্যবস্থা বা ইসলামী নীতি পালনের ক্ষেত্রে। অথচ দেখা যায়, সেসব দেশে ভাস্কর্যে ভরপুর। সেখানকার ইসলামি পন্ডিতগণ এ নিয়ে কী করছেন, তারা কি ভাস্কর্যকে মূর্তি বলছেন কি না, দেখা যাক।

বাংলাদেশের অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, যে সব ভাস্কর্যের ছায়া পড়ে তা মূর্তি, আর যে সব ভাস্কর্য পাথর বা কিছু খোদাই করে তৈরি করা হয়, ছায়া পড়ে না, তাঁদের ভাস্কর্য বলে। এই নিরিখেই যদি আমরা বিচার করি তাহলেও তাদের কথার সারবস্তুতে “মিথ্যাচার” বা “অপ-ব্যাখ্যার” প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাস্কর্য বা মূর্তি- যেটাই হোক, প্রতিটি বস্তুরই ছায়া পড়বে। অর্থাৎ ইসলামি চিন্তাবিদরা অ’বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়ে ভাস্কর্যের বিরো’ধীতা করছেন।

প্রত্যেকটি মুসলিম দেশেই ভাস্কর্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান। খোদ সৌদি আরবের রাজধানী জেদ্দার রয়েছে ভাস্কর্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নগরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাংরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য।

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কেন্দ্রস্থল সিটিডাল অব দামেস্কে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি বীর মুসলিম সেনাপতি সালাদিন (জন্ম: ১১৩৭ – মৃ’ত্যু: ১১৯৩)- এর স্মরণে নির্মিত ‘স্ট্যাচু অব সানেশিয়ায় জুড়েই রয়েছে প্রচুর ভাস্কর্য। এর মধ্যে বালিতে ভাস্কর্যের সংখ্যা বেশি।

ইমাম খোমেনি এবং ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিপ্লবের আদর্শ তুলে ধরতে ইরানে তৈরী করা হয়েছে প্রচুর ভাস্কর্য। বেশিরভাগই নির্মিত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের স্মরণে।

উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যগুলো হলো— তেহরানের ফেরদৌসী স্কয়ারে স্থাপিত মহাকবি ফেরদৌসীর ভাস্কর্য, ইরানের হামাদানে ইবনে সিনার ভাস্কর্য, তেহরানের লালেহ পার্কে ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য, কবি হাফিজের ভাস্কর্য, খোরাসানের মাসাদে নাদির শাহর ভাস্কর্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি (১৯০১ – ১৯৮৯) বা ইমাম খোমেনির একাধিক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল রয়েছে ইরানে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সাথে পরাজিত হয়ে পৃথক হওয়া পাকিস্থানেও রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দৃষ্টিনন্দন শিল্পভাস্কর্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- লাহোরে পাকিস্থানের জাতির পিতা জিন্নাহর ভাস্কর্য। স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে ষাঁড়ের ভাস্কর্য, লাহোরে বাদশাহি মসজিদের পার্শ্বে মেরি মাতার ভাস্কর্য, পাঞ্জাবের জং শহরের রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়সওয়ারের ভাস্কর্য, লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস প্রাঙ্গণের নানা ভাস্কর্য। রয়েছে বেনজির ভুট্টোর ভাস্কর্যও।

মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা ওয়াশিংটন মনুমেন্টের আদলে গড়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট ও ভাস্কর্য। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো: বাতু কেভসের বিখ্যাত প্রাচীন দেবতা মুরুগান এর ভাস্কর্য, কুচিং হলিডে ইন হোটেলের সামনে মার্জার ভাস্কর্য এবং কনফুসিয়াসের ভাস্কর্য।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা বুর্জ আল খলিফার বিপরীতে সংস্থাপিত আরবীয় যুগলের ভাস্কর্য, দুবাইয়ের ওয়াফি অঞ্চলের প্রবেশপথে পাহারাদারের নিদর্শন হিসেবে সংস্থাপিত কুকুরের ভাস্কর্য, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত ভাস্কর্য।

সমগ্র তুরস্ক জুড়ে রয়েছে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের (জন্ম: ১৮৮১ – মৃ’ত্যু: ১৯৩৮ সালে) অগণিত ভাস্কর্য। একেকটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যে একেক রকমভাবে আতাতুর্ক এবং তুরস্কের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে প্রকাশ করা হয়েছে।

কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য ছাড়াও তুরস্কে রয়েছে; মর্মর সাগর তীরে পোতাশ্রয়ে অপূর্ব মর্মর ভাস্কর্য, আঙ্কারাতে ইন্ডিপেন্ডেন্স টাওয়ারের পাদদেশে তুরস্কের জাতীয় সংস্কৃতির ধারক তিন নারীর ভাস্কর্য ও আন্তালিয়ায় এডুকেশন অ্যাক্টিভিস্ট তুরকান সায়লানের ভাস্কর্য।

কাতারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো ‘হারনেসিং দ্য ওয়ার্ল্ড’, যার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ। কাতারের রাজধানী দোহায় কাতার সংস্কৃতি কেন্দ্রে কাতারা আম্পি থিয়েটারের সামনে স্থাপিত হয়েছে পুরো পৃথিবীর সাথে সংযোগ স্থাপন করা নারী প্রতিমূর্তির অবয়বের এই অপূর্ব ভাস্কর্য।

ইরাকের রাজধানী বাগদাদে বেশকিছু বিখ্যাত ভাস্কর্য রয়েছে। সেগুলো হলো: ইন্টারন্যাশনাল জোনে অবস্থিত হাম্মুরাবির ভাস্কর্য। আরব্য উপন্যাসের সেই বিখ্যাত নগরী রহস্যময় বাগদাদ শহরের আবু নুয়াস স্ট্রিটে শাহেরজাদি পার্কে রয়েছে আরব্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শাহেরজাদি এবং কিং শাহরিয়ারের ভাস্কর্য। বিশ্বজুড়ে আলী বাবার গল্পের সেই মর্জিনাকে চেনে না এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। এই বুদ্ধিমতী দাসী মর্জিনার বুদ্ধিতে কুপোকাৎ হয়েছিল ৪০ চোর। সেই মর্জিনার ভাস্কর্যের দেখা মিলবে বাগদাদে আলী বাবা স্কয়ারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আরব বিশ্ব এবং পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মসুলিম দেশগুলোতে কি মামুনুল হক কিংবা চরমোনাইয়ের পীর ফয়জুল করিমের চেয়ে বেশী জ্ঞানী কিংবা ইসলামী বিশেষজ্ঞ মানুষ নেই? উত্তর হবে- অবশ্যই আছে। তবে তারা এদের মত ধর্মকে পুঁজি করে নিজেদের পকেট ভারী করে না। কিংবা সে দেশের পরাজিত শক্তির সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে ম’ত্ত হয়ে সে দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে অ’স্বীকার করে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের একটি ভাস্কর্য আছে যাকে আমরা অপরাজেয় বাংলা নামে চিনি ও জানি। এটি নির্মাণ করেন বীর মুক্তিযো’দ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরণটি করেছিলেন মুক্তিযো’দ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। তাই বলে এটাকে আমরা মূর্তি বলব? তাহলে পাকিস্থানের মহাম্মদ আলী জিন্নাহ’এ ভাস্কর্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে খামেনিসহ অন্য সব কবি বা বীরদের ভাস্কর্যকে আমরা কী বলব? আর ইসলামের সূতিকাগার সৌদি আরবে যে সব ভাস্কর্য আছে তা কেন মূর্তি আখ্যা দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় না!

আমাদের দেশের অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ মনে করেন, কিছু ইসলামিক গোষ্ঠী ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য খুব ভাল করেই বোঝেন। আসলে তাদের দিল জুড়ে আছে পাকিস্থান। এরা অধিকাংশই ১৯৭১ সালে পাকিদের সহযোগী ছিলেন তা না হলে তাদের আওলাদ। তাই তা কোনোভাবেই বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেন না। এ কারণে পাকিস্থানের জনক মহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র ভাস্কর্যকে তারা ভাস্কর্য বললেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে তা অপ’সারণের দাবি করছেন।

গাজীপুর কথা