ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ০৯ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ঝিনাইদহের তরুণ উদ্যোক্তা শিহাব উদ্দিন রঙিন মাছ চাষে সফল

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৯ মার্চ ২০২০

ঝিনাইদহের তরুণ উদ্যোক্তা শিহাব উদ্দিন রঙিন মাছ চাষে সফল

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রবাদ। এক সময় কৃষকের গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অনেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। নদী-খাল বিলেও তেমন দেশি প্রজাতির মাছ দেখা যায় না। তবে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ অনেক বেড়েছে। এ দেশের সীমানার ভেতরে চারশত প্রজাতির অধিক মাছ পাওয়া যায়। মাছের দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুব সমৃদ্ধ।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) মতে, বাংলাদেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশই এখন বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন মাছ চাষিরা। মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে ইলিশে প্রথম, মুক্ত জলাশয়ের আহরণে তৃতীয়, তেলাপিয়ায় চতুর্থ এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছে ৫ম স্থানের অধিকারী।

বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির (মোহনাজলসহ) এবং ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ১২-এর অধিক প্রজাতির চাষকৃত বিদেশি মাছ চাষের জলাশয়ে এবং ৭০-এর অধিক জাতের বিদেশি বাহারি মাছ অ্যাকুরিয়ামে পাওয়া যায়। 

মাছ চাষ অনেকেই শখ থেকে চাষ করে আবার কেউ বা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে। বর্তমানে রঙিন মাছ সকলের কাছে জনপ্রিয়। কেননা এই মাছ বাড়িতে অ্যাকুরিয়ামে চাষ করা যায়। কিন্তু হয়তো অনেকেই জানেন না এই রঙিন মাছ অন্য মাছের মতো পুকুরেও চাষ করা যায়। বাড়ির পাশে ছোটখাটো পুকুরে এই মাছ লাভজনকভাবে চাষ করা যায়। অন্য মাছের মতো পরিচর্যা করলেই চলে। 

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের তরুণ উদ্যোক্তা শিহাব উদ্দিন রঙিন মাছ চাষে সফল হয়েছেন। ২০১৮ সালের শুরুতে বাড়ির আঙিনায় একটি পরিত্যক্ত জমিতে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলেন অরনামেন্টাল ফিশ ফার্ম। পোনা কেনা, খাবার দেওয়াসহ নানা কাজে তার খরচ হয়েছিল ৩৪ হাজার টাকা। বছর ঘুরতেই মাছ বিক্রি করেছেন প্রায় এক লাখ টাকার। পরে সেই মাছ পুকুরে চাষ করেন। 

যে সকল শিক্ষিত বেকার মাছের খামার করতে আগ্রহী। তারা সহজেই এই মাছ চাষ করে লাভবান হতে পারবেন। রঙিন মাছ খাওয়ার চেয়ে অ্যাকুরিয়ামে পালনের চাহিদা বেশি। পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বর্তমানে আমাদের দেশে রঙিন মাছ চাষাবাদ অনেক গুণ বেড়ে গেছে। আগের মতো আমদানি করতে হয় না। 

জেনে নেওয়া যাক পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করার পদ্ধতি সম্পর্কে- 

পুকুর বাছাই : রঙিন মাছ চাষ করার জন্য ছোট অথবা মাঝারি সাইজের যে কোনো ধরনের পুকুর নির্বাচন করা যেতে পারে। তাছাড়াও বাড়িতে ছোটখাটো যে কোনো ধরনের জলাশয়ে এই মাছ চাষ করা যায়।

মাছ চাষ করার সঠিক সময় : সাধারণত তিন ধাপে রঙিন মাছ চাষ করা যায়। সেগুলো হলো- গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, এবং শীতকাল। গ্রীষ্মকালে টাইগার বার্ব, রোজিবার্ব, উইডো টেট্রা, শার্পে টেট্রা, সোর্ডটেল, মলি ও প্লাটি ইত্যাদি মাছের চাষ করা ভালো। বর্ষাকালে পার্ল গোরামী, কিসিং গোরামী, ডোয়ার্ফ গোরামী, ব্লু চিকলিড, জেব্রা চিকলিড, টেট্রা ও টাইগার ইত্যাদি মাছের চাষ করা ভালো। শীতকালের জন্য গোল্ড ফিশ, কই কার্প, ম্যানিলা কার্প ও ক্যাট ফিশ ইত্যাদি মাছ চাষ ভালো।

রঙিন মাছের পোনা ছাড়া ও যত্ন : রঙিন মাছ চাষ করার জন্য প্রথমে পোনা সংগ্রহ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে নিকটস্থ যে কোনো নার্সারি হতে পোনা আহরণ করা যেতে পারে। এরপর পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। তবে খেয়াল রাখবেন যে, পুকুরে রঙিন মাছের পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে সকাল অথবা সন্ধ্যা এই দুই সময়ের যে কোনো একটি নির্বাচন করতে হবে। কারণ এ সময় তাপমাত্রা সহনীয় অবস্থায় থাকে।

পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করার জন্য সঠিক নিয়ম অবলম্বন করতে হবে। পুকুরে পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে প্রথমে অক্সিজেন ব্যাগে পরিবহনকৃত পোনা ব্যাগসহ পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। এরপর পরিবহনকৃত ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা একই মাত্রায় আনতে হবে। তারপর ব্যাগের মুখ খুলে পুকুরের পানি অল্প অল্প করে ব্যাগে দিতে হবে এবং ব্যাগের পানি অল্প অল্প করে পুকুরে ফেলতে হবে। ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় ধরে এরূপভাবে পোনাকে পুকুরের পানির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

পুকুরে রঙিন মাছের পোনাকে সঠিক নিয়মে খাবার দিতে হবে। তা না হলে পোনা সঠিকভাবে বড় হবে না। রঙিন মাছের পোনার প্রিয় খাবার হলো, ব্রাইন শ্রিম্প, ইনফুসুরিয়ান্স, ওয়াটার ফ্লি, স্লাডজ ওয়ার্মস ও ব্লাড ওয়ার্ম ইত্যাদি। এগুলো পরিমাণ মতো মাছের পোনাকে খাওয়াতে হবে।

মাছের রোগবালাই ও প্রতিকার : পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করার জন্য মাছের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মাঝে মাঝে রঙিন মাছের বিভিন্ন রকমের রোগবালাই দেখা দেয় তাই সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখতে হবে। মাছের যত্ন নিতে হবে। যদি কখনো রঙিন মাছের রোগ দেখা দেয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে অথবা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

রাক্ষুসে মাছ দূরীকরণ : পুকুরে রঙিন চাষ করার ক্ষেত্রে আপনাকে প্রথমে পুকুরের রাক্ষুসে মাছ দূর করতে হবে। যেমন শোল, টাকি, গজার, বোয়াল ও মাগুর ইত্যাদি হলো রাক্ষুসে মাছ। এই মাছ রঙিন মাছের পোনা খেয়ে ফেলে। যার ফলে রঙিন মাছের ভালো ফলন পাওয়া যায় না। তাই সর্বপ্রথম রাসায়নিক সারের মাধ্যমে এই সকল মাছ দূরীভূত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে পুকুর বা জলাশয় সম্পূর্ণ শুকিয়ে ফেলতে হবে।

রঙিন মাছের যত্ন : পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে মাছের যত্ন নিতে হবে। পুকুরের পানির তাপমাত্রা সার্বক্ষণিক ঠিক রাখতে হবে। যদি পানির কোনো সমস্যা হয় তাহলে পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাছকে প্রজননের আগে ও পরে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। তা না হলে পানিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করে পানির সঠিক মান ফিরিয়ে আনতে হবে।

রঙিন মাছের প্রজনন পদ্ধতি : আমাদের দেশে বসন্তে ওই মাছের প্রজনন হতে দেখা গেছে। এ সময় স্ত্রী মাছের পেটে ডিম হয়। পুরুষ মাছের শুক্রাণু তৈরি হয়। প্রজননকালে পুরুষ ও স্ত্রী মাছ জলাশয়ের কিনারে প্রজননের জন্য জায়গা খুঁজতে থাকে। স্ত্রী মাছকে পুরুষ মাছ তাড়া করে বেড়ায়। তখন পানিতে বেশ শব্দ সৃষ্টি হয়।

প্রজননকালে পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছের পেটে আঘাত করে। একপর্যায়ে স্ত্রী মাছ ডিম ছেড়ে দেয়। পুরুষ মাছ ওই ডিমের ওপর শুক্রাণু ছেড়ে দেয়। এতে ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়। অনেক সময় নিষিক্ত ওই ডিম পরিণত মাছে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই ডিমগুলো পুকুরের আলাদা স্থানে রেখে যত্ন নিলে তা থেকে পোনা উৎপন্ন হবে।

ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ মাসে এরা প্রজনন করে। প্রতিটি মাছ ২-৩ হাজার ডিম দেয়। ডিমসহ কচুরিপানাগুলো পুকুরের পানিতে আলাদা করে হ্যাচিং নেটের ভেতরে রাখা হয়। এর ৭২ ঘণ্টা পর ডিমগুলো ফুটে পোনা তৈরি হয়। এক কেজি ওজনের প্রতিটি মাছ ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। ২০ থেকে ৩০ দিন বয়সী পোনা মাছ ২শ থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি হয়। ১ বছর বয়সী মাছ প্রজননক্ষম হয়।

এছাড়া অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বাসার ছাদেও রঙিন মাছের চাষ করে তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে পারবেন।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন