ঢাকা,  সোমবার  ১৭ জুন ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

গাজীপুরে তিন বছরে ১৯৮৪ জনের আত্মহত্যা

প্রকাশিত: ০০:২২, ২৬ মে ২০২৪

গাজীপুরে তিন বছরে ১৯৮৪ জনের আত্মহত্যা

ফাইল ছবি

একটি কাপড়ের দোকানের কার্মচারী মো. হৃদয় (২২)। তিনি গোপনে আর্জিনা নামের এক মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী আছে সেই বিষয়টি জানতেন না আর্জিনা। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হত। এর জের ধরে দ্বিতীয় স্ত্রী আর্জিনাকে রাতে নিজ ঘরের খাটের সঙ্গে হাত-পা বেধে এবং মুখে কাপড় গুঁজে তার সামনেই ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন হৃদয়। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামের মসজিদ মোড় এলাকায়। 

গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর এলাকার রবিউল ইসলাম। স্থানীয় একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। একই ক্লাসের এক মেয়ে শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুব দ্রুতই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তবে কয়েক মাসের মধ্যে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। এতে অভিমান, হতাশায়গ্রস্থ হয়ে পড়ে রবিউল। ক্লাসের বন্ধুরাও তাকে বিষয়টি নিয়ে কটাক্ষ করতো। অভিমানে রবিউল বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তার পরিবার টের পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে যাত্রায় তার প্রাণ বেঁচে যায়। এটি শুধু একজন রবিউলের গল্প নয়, গাজীপুরে এমন তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। 

জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুরে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গাজীপুর মহানগর ও জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গত তিন বছরে গাজীপুরে আত্মহনন করেছেন  এক হাজার ৯৮৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক হাজার ১৩ জন এবং নারী ৯৭১ জন। যাদের বেশিরভাগই তরুণ এবং শিক্ষিত। এছাড়াও ২০২১ সালে মোট ৬৮৫ জন আত্মহত্যা করেছে, এরমধ্যে পুরুষ ২৮৭ ও ৩৯৮ জন নারী। ২০২২ সালে ৬৩৪ জনের মধ্যে পুরুষ ৩৭২, নারী ২৬২ জন। ২০২৩ সালে ৬৬৫ জনের মধ্যে পুরুষ ৩৫৪ জন, নারী ৩১১ জন।

যদিও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত ৩ বছরে আত্মহত্যা করেছেন ৪৪৪ জন৷ এরমধ্যে ২০২১ সালে ১৯৬ জন, ২০২২ সালে ১৯২ জন এবং ২০২৩ সালে আত্মহত্যা করেছেন ৫৬ জন৷ বেশিরভাগ বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের থেকে বেশি৷ 

গাজীপুর জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী, গত তিন বছরে জেলার ৫টি উপজেলায় আত্মহত্যা করেছে মোট ৭৬৬ জন৷ ২০২১ সালে ২৮১ জন, ২০২২ সালে ৩০০ জন এবং ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ১৮৫ জন। এরমধ্যে জয়দেবপুর থানায় ৯৮ জন, কালিয়াকৈর উপজেলায় ২০০ জন, শ্রীপুর উপজেলায় ২৪৭ জন, কাপাসিয়া উপজেলায় ১২৭ জন ও কালীগঞ্জ উপজেলায় ৯৪ জন আত্মহত্যা করেছে। 


গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মাযহারুল হক জানান, গাজীপুরের অধিকাংশ যুবক-যুবতীদের আত্মহত্যার ঘটনা আবেগতাড়িত। চাকরি হারানো, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থ, পরীক্ষার ফল খারাপ, বাবা মায়ের সঙ্গে ঝগড়াসহ ছোটখাটো বিষয়েই আবেগতাড়িত হয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। 

আর আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গাজীপুর শ্রমিকঘন এলাকা হওয়ায় এখানে সারাদেশের মানুষের বসবাস। নানা কারণে পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা-প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় ও মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এছাড়া অনেক সময় দেখা যায় পারিবারিক ব্যয় ভার বহন করতে অক্ষম ও অতিরিক্ত ঋণের চাপ সয়তে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। 

এছাড়াও মানুষের টাকা-পয়সা একটা দিক আর বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে আরেকটা দিক। টাকা-পয়সা আর বুদ্ধিমত্তার একটা সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। যদি সমন্বয় না থাকে তাহলে একজন মানুষ আত্মহত্যার দিকে দাবিত হয়। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশাগ্রস্থ করে তুলে। যার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা সাধারণত ইউডি (আননেচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু) হিসেবেই থেকে যায়। এসব ইউডি মামলা পুলিশ নিজে থেকে যদি তদন্ত করা হয় তবে প্রতিটি আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব। তবে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আইনের এই ধারাটিকে গুরুত্বহীন ভাবে দেখা হয়। 

আত্মহত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ উল্লেখ করে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নিয়মিত সদস্য অ্যাডভোকেট মো. সুমন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৩০৯ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, যদি কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং অনুরুপ অপরাধ সংঘঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। আত্মহত্যা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনেও অন্যায় ও পাপ কাজ। বিষয়টি নিয়ে সবার সচেতনতা প্রয়োজন।