ঢাকা,  রোববার  ১৬ জুন ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

প্রাণিসম্পদের সব তথ্য মিলবে এক ক্লিকে

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২২ মে ২০২৪

প্রাণিসম্পদের সব তথ্য মিলবে এক ক্লিকে

ফাইল ছবি

ঢাকা জেলার ধামরাই থানার রফিকুল ইসলাম ৬টি গরুর মালিক। তার মধ্যে একটি ষাঁড়, দুটি গাভি, দুটি বাছুর, একটা বকনা। বাছুরের মধ্যে একটির বয়স ৬ মাস, অপরটির ৪ মাস এবং বকনাটি গাভিন। গাভি দুটির মধ্যে একটি ১০ থেকে ১২ লিটার, অপরটি আড়াই লিটার দুধ দেয়। ১০টি দেশি মুরগিও আছে। হাঁস আছে দুটি।

রফিকুলের মতো সারা দেশে যত মানুষের যত পরিমাণ গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি, কোয়েল-কবুতরসহ গৃহপালিত পশুপাখি আছে, তার হিসাব একনিমিষে করে ফেলা যাবে এখন থেকে। দেশের ৮ বিভাগের ৬১ জেলার (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ছাড়া) ৪৬৬টি উপজেলায় ১ কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬৭টি পরিবারের মধ্যে ‘লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইম্পর্ট্যান্স অব ডেটাবেজ : হাউসহোল্ড ডিজিটাল লাইভস্টক সার্ভে-২০২৪’ নামে একটি জরিপকাজ করা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে ২৮ মার্চ পর্যন্ত জেলা পর্যায়ে এবং ২৮ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকায় জরিপ করেছে। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ শেষে এটির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অচিরেই তা প্রকাশ করা হবে।

কেন এই জরিপ

জরিপটি কেন করা হয়েছে এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কৃষি খাতের জন্য প্রতি দশকে একবার কৃষিশুমারি করে প্রাণিসম্পদ সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও প্রকাশ করে থাকে। একই বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পরিসংখ্যান প্রস্তুত ও প্রকাশ করে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রথমবারের মতো ৬১টি জেলার সকল উপজেলা, পৌরসভা ও মেট্রো এলাকায় প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট সকল হোল্ডিংসের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই তথ্য সংগ্রহের কাজটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। 

জরিপের প্রশ্নমালা বা ফরম্যাট প্রস্তুত করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প এবং এফএও যৌথভাবে একটি ফরম্যাট তৈরি করে। এজন্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসনকে সভাপতি করে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়। বিবিএসের প্রতিনিধি সমন্বয়ে এই কমিটি বৈঠক করে এবং তাদের কারিগরি পরামর্শে ফরম্যাট ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হয়। 

স্বনামধন্য প্রোগ্রামিং প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার প্রস্তুত করে এবং কয়েকটি উপজেলায় পাইলটিং করে তা চূড়ান্ত করা হয়। আর তথ্য জমাকরণে সার্ভার ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নামে সার্ভার সুবিধা নেওয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহকারী ও মনিটরিং সুপারভিশনের জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে ইউনিয়ন পর্যায়ের এলএসপি এবং উপজেলায় কর্মরত প্রাণিসম্পদ মাঠসহকারী ও অন্যান্য স্টাফের তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহারের যাবতীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া এই কর্মযজ্ঞ মনিটরিং ও সুপারভিশনের জন্য প্রকল্পের প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং ক্ষেত্রবিশেষে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

যেভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে জরিপকাজ

জরিপকাজ বাস্তবায়নের জন্য ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়কাল বেছে নেওয়া হয় বলে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান। সূত্র জানায়, আবহাওয়াগত দিক থেকে এ সময়টা ভালো থাকে। তাই চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া জরিপে মাঠকর্মীরা ইলেকট্রনিক ডিভাইস, পরিচিতি কার্ড এবং স্থায়ী মার্কার নিয়ে বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্যদাতা বা খানার খামারের নাম-ঠিকানা, সেলফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, গবাদিপশুর তথ্য গ্রহণ করা হয়। যেমনÑ প্রাপ্তবয়ষ্ক গাভির সংখ্যা (দেশি ও সংকর), দুধেল গাভির সংখ্যা, প্রতিটির বয়স, পুরুষ (ষাঁড়) গরুর সংখ্যা (দেশি ও সংকর), পুরুষ বাছুর ও স্ত্রী বাছুরের সংখ্যা, খামারে দৈনিক মোট দুধ উৎপাদন, অনুরূপভাবে মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া ও শূকরের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। পোল্ট্রির ক্ষেত্রে দেশি মুরগি, সোনালি, ব্রয়লার, লেয়ার মুরগি, খামারে ডিমের উৎপাদন, কোয়েল পাখির সংখ্যা, বাচ্চার সংখ্যা, টার্কি ও তিতিরের সংখ্যা, হাঁসের সংখ্যা, হাঁস-মুরগির ডিমের উৎপাদন, কবুতরের সংখ্যা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি গবাদিপশুর জন্য সবুজ ঘাসের উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ এবং তথ্য সংগ্রহকারী চিহ্নিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে রাখা হবে। অনলাইনে ডেটা আপলোড দিলেই ওই স্থানের জিওলোকেশন অটোমেটিক নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। প্রতিদিন ১০ হাজারের অধিক কর্মী তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং গড়ে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ হোল্ডিংসের তথ্য জমা হয় তথ্যসার্ভারে। ডেটা রিপিট বা ডুপ্লিকেশন এড়াতে অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারে ইন্টেলিজেন্স রাখা হয়। দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে কন্ট্রোল রুম থেকে তদারকি করা হয়। 

সেক্টরের উন্নয়নে জরিপ দরকার

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, জরিপটির মূল উদ্দেশ্য একটি ডেটাবেজ ডেভেলপ করা। কেননা একটি সেক্টর বা সাব-সেক্টরকে উন্নয়ন করতে হলে ভিত্তি তথ্য দরকার পড়ে। দেশে কোন জাতের কতগুলো গবাদিপশু আছে। তাদের কোনটার বয়স কত, গাভি কত লিটার দুধ দেয়। দেশে গবাদিপশুর উৎপাদন কত, চাহিদা কত ও ঘাটতি কতটা আছেÑ এসব হিসাব বের করতে সহজ হয়। এসব হিসাব করে আমদানি-রপ্তানির প্রয়োজন কতটুকু তা নির্ধারণ করা যাবে। এসব প্রাণীর খাদ্য কতটুকু দরকার, তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কতটুকু সরবরাহ করা যাবে, আমদানি কতটুকু করতে হবে ইত্যাদি। প্রতিনিয়ত দেশে গবাদিপশুর জন্ম হচ্ছে, জবাই হচ্ছে। এসবের সঠিক ও আপডেট তথ্য দরকার। 

তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য এসব তথ্য কাজে আসবে। কোন অঞ্চলে কী পরিমাণ গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি আছে। ঘাস চাষের সুযোগ আছে। সেখানে কী ধরনের বাজার তৈরি করা যায়, এসব তথ্য জানা যাবে। তাতে করে বিনিয়োগ করতে সুবিধা হবে। এসব তথ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে থাকবে। একটা ক্লিক করেই যে যার চাহিদামতো তথ্যগুলো পেয়ে যাবে।

‘উন্নত দেশে প্রতিবছর জরিপ হয়’

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে প্রায় প্রতিবছরই জনসংখ্যা, প্রাণিসম্পদ, খাদ্য উৎপাদন নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয় বলে জানান বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোতে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব গত বছর কেমন ছিল, চলতি বছর কেমন যাবে এসব নিয়েও জরিপ হয়। নতুন কোনো পোকামাকড় দেশে এসেছে কি না সেসব তথ্য হালনাগাদ করা হয়।

প্রাণিসম্পদ নিয়ে কেন জরিপ করতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে আমাদের চাহিদা তথা জনসংখ্যা অনুযায়ী কতগুলো ডিমের প্রয়োজন, কী পরিমাণ মাংস, দুধের প্রয়োজন সে অনুযায়ী উৎপাদন কত; মাংসের মধ্যে গরু, ছাগল, মহিষ বা মুরগির মাংস কতটুকু দরকার এসব রেশিও করতেই জরিপ করা হয়ে থাকে। 

তিনি আরও বলেন, জরিপের মধ্যে এটিও থাকতে হয় নতুন কোনো রোগজীবাণু এলো কি না। যদি এসে থাকে তা কতটুকু ক্ষতি করতে পারে, সেজন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু থাকা প্রয়োজন, সেই তথ্যও থাকতে হবে। যেমনÑ পার্শ্ববর্তী দেশে কোনো নতুন রোগ দেখা দিল তা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি কেমনÑ এসব কারণেও জরিপ দরকার পড়ে। 

জনগণ সঠিক তথ্য দিতে চায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্যে ফারাক দেখা যায়। এর কারণ জনগণ সঠিক তথ্য দিতে চায় না। তথ্য যে বিশাল সম্পদ, এটি তাদের আজও বোঝানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া জনবলের অভাবের কারণে মাঠপর্যায়ে না করে বরং স্যাম্পলিং সার্ভে করা হয়। এতে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। বর্তমান জরিপটি যদি পর্যাপ্ত জনবল দিয়ে করা হয়ে থাকে, তাহলে আশা করি সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।

জরিপের কারণে চিকিৎসা দেওয়া সহজ হবে

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক মঙ্গলবার বলেন, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে প্রাণিসম্পদ ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল আছে। সেখানকার চিকিৎসকদের কাছে তথ্য থাকলে তারা সহজে প্রান্তিক চাষি বা খামারির গবাদিপশু ও পাখিগুলোকে চিকিৎসা দিতে পারবেন। টিকাসহ অন্যান্য ওষুধপত্রের চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারবেন। তাছাড়া প্রয়োজন হলে চিকিৎসক নিজেই সেই খামারির বাড়িতে গিয়ে পশুপাখিকে চিকিৎসা দিয়ে আসতে পারবেন। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন। আশা করি, এই সার্ভেটি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।