ঢাকা,  শুক্রবার  ২৬ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

পেছন ফিরে দেখা ৭ নভেম্বর

প্রকাশিত: ১৪:৫৬, ৭ নভেম্বর ২০২১

পেছন ফিরে দেখা ৭ নভেম্বর

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ যতটা উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছিল, ৭ নভেম্বরের পর তা আরও তীব্র গতিতে একাত্তর-পূর্বকালের পাকিস্তানি দর্শনের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। যার ফল আজকের সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট বিভক্তির বাংলাদেশ, চরম রাজনৈতিক বিদ্বেষ বিভেদের বাংলাদেশ।
সে কারণেই ভয়াবহ ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের চেয়ে কম ভয়াবহ নয় ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি হিসেবে সেনাবাহিনী প্রধান হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে খালেদ মোশাররফের সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ তথা সামরিক অভ্যুত্থান এবং কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থার প্রত্যক্ষ সশস্ত্র পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়ার মুক্তি তথা ৭ নভেম্বর সংঘটিত তথাকথিত ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’। এই ‘বিপ্লব’ কার স্বার্থে? দেশের জনগণ, লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সশস্ত্র বাহিনী নাকি মুক্তি পাওয়া জিয়াউর রহমানের কাছে চরমভাবে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া জসদের?
ঘটনার ৪৫ বছর পার হলেও এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় কি এখনও আসেনি? ইতিহাসের স্বার্থেই সেই সত্য উদঘাটিত হওয়া উচিত। প্রশ্ন আরও আছে, খালেদ মোশাররফের কী লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানে এবং তিনদিনেও তিনি কেন সরকার গঠন ও জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দিয়ে তার অভ্যুত্থানের ব্যাখ্যা করতে পারলেন না, তাও জানা প্রয়োজন। আরও জানা প্রয়োজন, ৭ নভেম্বর সকালে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এসে কারা খালেদ মোশাররফ এবং তার অপর দুই সঙ্গী সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলেন? কে নির্দেশ দিয়েছিল তাদের হত্যা করতে!
না এসব কোনো প্রশ্নেরই উত্তর আজও মেলেনি। খালেদ মোশাররফের মতো বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তাকে এবং মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের নির্বিচার হত্যার বিচার তো হয়ইনি, হয়নি কোনো তদন্ত!
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের পুতুল সরকার এবং নতুন সেনাপ্রধান জিয়ার নিয়ন্ত্রণহীনতায় মুক্তিযোদ্ধা - অমুক্তিযোদ্ধা বিরোধ সেনাবাহিনীর ভেতরে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা সুস্পষ্ট। এমন বাস্তবতায় কয়েকজন ঘাতক মেজর বঙ্গভবনে বসে পুতুল সরকার পরিচালনা করবে, সেনাবাহিনীর অনেকেই তা মানতে পারেননি। তারই বিস্ফোরণ বলা যায় ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানকে।
এযাবৎ যেসব বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাতে এই সত্যটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তাতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর অপসংস্কৃতিও তৈরি হয়েছিল সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে।
যে কারণেই সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে থাকুক না কেন, জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান যদি সফল হতো, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায়- বাংলাদেশে তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের হারানো পথ সহজেই ফিরে পেত। খালেদের অভ্যুত্থান শেষপর্যন্ত সফল হতে পারেনি জাসদের গণবাহিনী, সৈনিক সংস্থার গোপন প্রস্তুতিতে ব্যাপক তৎপরতা ও যৌথ অভিযানের ফলে।
প্রসঙ্গত, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে কিছুকাল পর বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাসদে যোগ দেন। সেনাবাহিনীর ভেতরে গোপনে সাধারণ সৈনিকদের নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাও গড়ে তুলেছিলেন।
বেসামরিক ‘গণবাহিনী’ আর সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ‘সৈনিক সংস্থা’ গড়ে নিয়ে কাজ করছিল জাসদ। ৭ নভেম্বরে এই শক্তির বলেই পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে আনে জাসদ। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে তাহের জিয়াকে তার সহযোগী হিসেবে পাওয়ার জন্য এই অভ্যুত্থান ঘটান, তা ব্যর্থ হয় জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায়। সেকথা জাসদের নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং লেখায় পাওয়া যায়।
কর্নেল তাহের জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ৭ নভেম্বরের পাল্টা ক্যু ঘটাননি। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তিনি চেয়েছিলেন তার সহযোগী সমর্থক হিসেবে। যে কারণে খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের পর ৬ নভেম্বর তাহেরের অনুসারী গণবাহিনী ও তার গড়া সৈনিক সংস্থা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে একটি লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেয়া জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল ও কর্নেল হুদাকে ‘ভারতের চর’ বলে প্রচার করা হয়েছিল।
ওই লিফলেট সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ফলে ঢাকা সেনানিবাসে গণবাহিনীর অস্তিত্ব প্রথম প্রকাশ পায়। জিয়া মুক্ত হওয়ার পর কর্নেল তাহেরের সঙ্গে তার বিশ্বাসভঙ্গের আচরণে তাদের মধ্যে চরম মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়।
জাসদের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের বিপরীত চিন্তার মানুষ পাকিস্তানি দর্শনে বিশ্বাসী জিয়াউর রহমানের হাতে নিজেদের অজান্তেই যেন ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল জাসদ। তার চরম পুরস্কারও তারা পেয়েছে জিয়ার কাছ থেকেই। ১৯৭৫-এর ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার এবং ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই প্রহসনের আদালতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ডের নামে হত্যা করা হয় বিপ্লবী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে যারা ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ বলে অভিহিত করতে চান তারা যুক্তি দেখান: সেদিন ঢাকার রাজপথের সৈনিক-জনতা নেমে এসেছিল উল্লাসে। যারা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে ট্যাঙ্কে চড়ে জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করেছিলেন, তারা আসলে সেনাবাহিনীর কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করেন? আর জনতা বলতে কাদেরকে বোঝানো হচ্ছে?
আসল চিত্র হচ্ছে এটি জাসদের একটি রাজনৈতিক বিজয় মিছিল। এখানে যারা উল্লাস করেছিলেন তারা গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থার সদস্য, দেশের সাধারণ মানুষ কিংবা সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক নয়। পোশাকধারী সৈনিক যারা তারা প্রায় সবাই ছিলেন সৈনিক সংস্থার আদর্শে বিশ্বাসী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।
এই বিভ্রান্তির মধ্যে দিয়েই তথাকথিত ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ পালন করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দুটি সামরিক সরকার। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতাসীন হয়েও পরবর্তীকালে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করেছে, এমনকি সরকারি ছুটির দিনও করেছে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ অবস্থাই বিরাজমান ছিল।
আজ যখন ইতিহাসের দিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কেউ তাকান, তাহলে যা দেখবেন, তা হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদ যদি ওই ভূমিকা গ্রহণ না করত, তাহলে হয়ত খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহ রাষ্ট্র হিসেবেই গড়ে উঠতে পারত। আজকের বাংলাদেশ অন্তত দেখতে হতো না, যে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ও সামরিক দর্শনে বিশ্বাসী শক্তি প্রায় সমান্তরালে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
যে কারণে দেশ উন্নতির দিকে এগোলেও, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠছে না কিছুতেই। কারণ সেই ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছে ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, যে শক্তি সৃষ্টি হয়েছে ১৫ আগস্টের বেনিফিশিয়ারিদের প্রযত্নে।
এ প্রসঙ্গে এ তথ্যও অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, ৭ নভেম্বর শুধু একজন বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত খালেদ মোশাররফকেই হত্যা করা হয়নি, আরও অনেক বীর উত্তম, বীর বিক্রম মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ৮১ পর্যন্ত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, কখনও বিচারের নামে প্রকাশ্যে, কখনও গোপনে!
ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস বাংলাদেশের কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তার যে ভাষ্য তা-ই তো ভয়ংকর! শুধু পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি তার লিগ্যাসি অব দ্য ব্লাড গ্রন্থে!
আরও একজন, তিনিও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট লেখক গবেষক গোলাম মুরশিদ তার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপরে’ গ্রন্থে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতেও ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া যাবে! তিনি ৭ নভেম্বর জিয়াকে মুক্ত করার ওই দিনের ঘটনায় লিখেছেন:
“গৃহবন্দী জিয়াকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল। অন্যতম লান্স্যার মহিউদ্দিন ছিল এই দলের নেতৃত্বে।”
বঙ্গবন্ধুর দুই হত্যাকারী কর্নেল ফারুক আর ল্যান্সার মহিউদ্দিনের মতো লোকেরা এ কাজে জড়িত থাকবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এসব তথ্য এবং ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে কীভাবে থাকবে!

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন