ঢাকা,  শনিবার  ২৭ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

দৃষ্টি

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ২৪ জানুয়ারি ২০২২

দৃষ্টি

‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’- জীবনানন্দ দাশ

পকেট গেইটের উল্টোদিকে পিচের রাস্তার পশ্চিম পাশে বটগাছটি। সেটির পেছনেই একটা পানির পাম্প। ওয়াসার। পাম্প ঘরের সামনের দেয়ালটা উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। রাস্তার সমান্তরালে। দেয়ালটির গায়ে একটি  সিমেন্টের রিলিফ ওয়ার্ক। জলের ফোঁটা। ত্রিমাত্রিক। ফাঁপা বেলুনের মতো। চিকণ প্রান্ত ওপরের দিকে। দেয়ালের গা থেকে ঝুলছে। ধূসর নীল রঙের। রঙটা লাল হলে এক বিন্দু রক্তের ফোঁটা মনে হতো। এটা ঢাকা ওয়াসার প্রতীক চিহ্ন।

গাছটার বয়স কমপক্ষে এক শতাব্দী। কাণ্ড আর শাখা-প্রশাখা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তবে খুব বড় নয়। সামনের  রাস্তা এবং পেছনের সরকারি দেয়ালের মাঝখানে জন্মানোর কারণে বেড়ে উঠতে পারেনি। ইচ্ছেমতো। সূর্যমুখী ফুলের মতো যখনই যেদিকে গ্রীবা বেঁকিয়ে বাড়তে গেছে, তখনই তাকে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কাক ছাড়া অন্য কোনো পাখি বসে না এর শাখা-প্রশাখায়। গাছটির দুইদিকে দুটো মেইকশিফট দোকান। সিমেন্টের দেয়ালের। গাছটির কাণ্ডের গোঁড়ার দিকে প্রায়ান্ধকার একটা ফাঁকা জায়গা। ওপর থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূমির দিকে নেমে এসেছে বটের ঝুলন্ত শিকড়গুলো। সাপের মতো। এঁকেবেঁকে নারীর কপালের ওপরে ভেজা চুলের গুচ্ছের মতো লেপ্টে আছে দেয়ালের গায়ে। শুধুমাত্র এটাই এক ধরনের পৌরাণিক নান্দনিকতা প্রদান করেছে গাছটিকে। কম্বোডিয়ার এঙ্কর ওয়াটের ভেতরের শতবর্ষী বটগাছের মতো। 

গাছটির কোটরের ভেতরে একটা অতি জীর্ণ চায়ের দোকান। কাক অথবা কবুতরের বাসার মতো। ওপরটা নীল পলিথিন দিয়ে ঢাকা। এই পলিথিন ভেদ করে গাছের শিকড়গুলো ওপর থেকে নিচে নেমে এসে পুনরায় ডানে বামে চলে গেছে। বিখ্যাত কোনো পাঁচ তারা হোটেলের সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমের পাইপের মতো। বৃষ্টির ধারা নেমে আসে পলিথিনের ছিদ্র দিয়ে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সকল ঋতুতেই এই কোটর কুয়াশা কিংবা সিগারেটের ধুঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে!

আমার ছোট মেয়ের একটা পোষা বিড়াল ছিল। একদিন অকারণেই বিড়ালটা হারিয়ে গেল। মেয়ের খুব মন খারাপ। আমরা গাড়িতে করে যেখানেই যাই না কেনো, তার চোখ সারাক্ষণ হারিয়ে যাওয়া বিড়ালটাকেই অনবরত খুঁজতে থাকে। জায়গাটা আমার বাসা থেকে কাছেই। একদিন ওকে নিয়ে পকেট গেইট দিয়ে বেরিয়ে রিকশায় করে পুরাতন কচুক্ষেত বাজারের দিকে যাবার সময়ে সে বলল, ‘পাপা, আমি আমাদের বিড়ালটাকে বটগাছটার কোটরের ভেতরের দোকানের ছাদে দেখেছি। গতকাল বিকেলে।’ রজনীগন্ধা অফিসার্স বাসস্থান এলাকার মসজিদের পশ্চিম পাশে শিশুদের খেলার জন্যে একটা উঁচু স্লাইড আছে। এই স্লাইডের চূড়ায় আরোহণ করলেই এলাকার প্রাচীরের ওপারের সবকিছু দেখা যায়।

সুতরাং বিকেলের দিকে আমি দোকানটায় গেলাম। বিড়ালের খোঁজে। আশেপাশে বিড়ালের টিকিও দেখা গেল না। শীতের লম্বা কোট পরে এক বর্ষীয়ান লোক কোটরের ধুঁয়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। এক চোখ অন্ধ। অন্য চোখের রঙ ভীষণ ঘোলাটে। ডায়াবেটিসের রোগীর চোখের মতো। কোনোই গভীরতা নেই। অথবা দিনের আলোতে আমাদের হারিয়ে যাওয়া বিড়ালের চোখের মতো। কোটরের দোকানের মালিক ইনিই। পেছনের বটগাছের মতোই প্রাচীন এই ব্যক্তি। আমি দূর থেকে রাস্তা অতিক্রম করার সময়ে অনেক বারই তাকে দেখেছি। গ্রীষ্মকাল ছাড়া বর্ষা, শরত, হেমন্ত অথবা শীত সব ঋতুতেই সে নিলামের দোকান থেকে কেনা এই পুরনো কোটটা পরে থাকে। তাকে দেখলেই আমার দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত এক উপন্যাসের চরিত্র বলে মনে হয়। কখনই বসে না। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চা তৈরি করে। বিক্রি করে। এই দোকানের জন্যেও কি তাকে ভাড়া দিতে হয়? আমি জানি না। হয়তোবা দিতে হয়। অথবা দিতে হয় না। তবে এই এলাকাটা সরকারি। 

মাঝে মধ্যেই আমি এই চায়ের দোকানে যেতাম। বিড়াল খুঁজতে যাবার পর থেকে। একটা জনাকীর্ণ উজ্জ্বল নগরের ছোট্ট এই অংশের প্রায়ান্ধকার ভাবটা আমার সত্যিই ভাল লেগে গিয়েছিল। চা খেতে, বিড়ালের খোঁজে, অথবা বিড়াল চোখের এই মানবের এবং তার সঙ্গীদের সাহচর্যের জন্যে আমি সেখানে যেতাম। দোকানে সর্বক্ষণ কয়েকজন বসে থাকে। এরা আমাকে কেউই চিনে না। অথবা চিনলেও প্রকাশ করে না। এমন কি আমার বিষয়ে কোন ধরনের আগ্রহও প্রদর্শন করে না। বয়স্ক দোকানি লোকটি যত্ন করে সবার জন্যে কন্ডেন্সড মিল্ক এবং অতিরিক্ত চিনি দিয়ে চা বানিয়ে দেয়। কোন কথাই বলে না। মাঝে মধ্যে মনে হয় সে বোবা। তবে অন্য বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা আলাপচারিতা অথবা খোশগল্পে মেতে থাকে। এদের ভেতরে একজন স্থানীয়। সবচেয়ে প্রবীণ। ওয়াসার পাম্পের পেছনেই হয়তো তার বাড়ি। এই লোক সারাক্ষণ স্মৃতিচারণ করেন। পাকিস্তান আমল, কচুক্ষেত সেনানিবাসের সৃষ্টি, বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ির গল্প, সরকার বাড়ির গল্প। তাদের ভূমিহীন হবার গল্প। আমি জানতামই না যে এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসের স্টাফ রোড জায়গাটার নাম ছিল ‘সরকার বাড়ি’। যেখানে বর্তমানে ‘ নক্ষত্র ‘ নামের অট্টালিকা দিবারাত্রি আলোর কিরণ বিতরণ করে যাচ্ছে।

মাঝে মধ্যে দুই একজন আসে, যারা অসাধারণ সব গল্প শোনায়। একদিন একজন এসেই বলল, ‘‘একবার গিয়েছিলাম প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের বাসায়। বিরাট ড্রইং রুম। ৩০/৪০ জন বসে আছে। একটা বিরাট গামলার ভেতরে মুড়ি রাখা আছে। তার পাশেই প্রকান্ড এক কাঁঠাল ভেঙে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ফল। সবাই মনের সুখে খাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর প্রেসিডেন্ট এলেন। লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরিহিত। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেছি। তিনি এক এক করে সবার সামনে যাচ্ছেন। এক লোক বলল, ‘স্যার, আমার ছেলেটাকে সেনাবাহিনীতে ঢুকাতে চাই’। প্রেসিডেন্ট অবাক। তিনি বললেন, ‘তাহলে আর্মি স্টেডিয়ামে না গিয়ে আমার কাছে এসেছ কেন?’ পরের জন কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার মোবাইল নম্বরটা আমার দরকার!’ প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘ পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আমার মতন বুড়া মানুষের মোবাইল নম্বর তোমার দরকার হল!’ আমি ভীষণ মজা পাচ্ছি। আমার সাথে সাথে মনে পড়ে গেল আমার সতীর্থ এক এস এস এফ( স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) অফিস্যারের কথা, প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহাব উদ্দিন প্রেসিডেন্ট হবার পর প্রথম দিন বঙ্গভবনে এসেছেন। বঙ্গভবনের চারপাশের দেয়াল জুড়ে অসংখ্য সিকিউরিটি পোস্ট। সবগুলোই চতুষ্কোণ আকারের। প্রেসিডেন্ট বিস্মিত কন্ঠে আমার পরিচিত অফিসারকে বললেন, ‘ওই গুলা কি? পায়খানা নাকি?’ আমি হাসতে হাসতে অস্থির। আমি খেয়াল করেছি বিখ্যাত ব্যক্তিরা অনেক সময়েই সাধারণ মানুষের মতন আচরণ করেন। হেমলক পান করার পূর্বে সক্রেটিসের শিষ্যরা সবাই মিলে তাঁর কাছে গেল তার নিকট থেকে শেষ অমূল্য উপদেশ শোনার জন্যে। সক্রেটিস জ্ঞানগর্ভ কিছুই বললেন না। শুধু তার সবচেয়ে প্রিয় শিষ্যকে কাছে ডেকে নির্দেশ দিলেন যে অমুকের কাছ থেকে তিনি একটা মুরগি নিয়েছিলেন। সেটার দামটা যেন তাকে দিয়ে দেয়া হয়!

প্রতিদিনই রাতের নিশুতি প্রহর কেটে যাবার পর ভোরবেলার নিঃশব্দ প্রস্তুতি শুরু হয় আকাশ মাটিতে। সেই লোকটি তখন দোকানে দাঁড়ায়। প্রত্যাবর্তন করে রাত এগারোটার পর। কোনদিনই এর ব্যত্যয় সে করে না। আমি প্রায়ই খেয়াল করেছি সারাক্ষণ সঙ্গীদের সাথে থাকার পরেও লোকটা বেশির ভাগ সময়েই অন্যমনস্ক থাকে। জাগ্রত একটা চোখ দিয়ে সে কোনো এক অনির্দেশ্য দৃষ্টিতে সামনের ছোট আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার দৃষ্টি রাস্তার অপর তীর পর্যন্ত প্রসারিত হয় কিনা সে সম্পর্কে আমার প্রচুর সন্দেহ আছে।

একদিন আমি তাকে তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করি। তার দুই ছেলে, তিন মেয়ে। বড় ছেলেটা তিতুমীর কলেজে পড়ে। অন্যটা ক্লাস টেনে। বড় মেয়ে আগে পড়ত। এখন পড়ে না। এই চায়ের দোকানের উপার্জনের ওপর পুরো পরিবার নির্ভর করে। সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী এই রাস্তার সংস্কার কাজ চলছে। রাস্তার পশ্চিম পাশের এই দোকানগুলোকে ভেঙে দিয়ে রাস্তাকে প্রশস্ত করা হবে। ওগুলো ভেঙে দিলে তার এই দোকানও থাকবে না। অতঃপর তার সন্তানগুলো নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার সে কিছুই জানে না!

পরের বছরের শীতে একদিন আমি তার দোকানে গিয়ে দেখি সে দোকানে অনুপস্থিত। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। খেয়াল করলেই বোঝা যায় তার ছেলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাবা কোথায়? অসুস্থ নাকি? না কি দেশে গেছেন?’ ছেলেটা খুব সংক্ষিপ্তভাবে আমাকে জানাল যে তাদের দেশে কোনো ফিরে যাবার জায়গা নেই। মাত্র দুইদিন আগে তার বাবা শেষরাতে চায়ের পানি গরম করে দোকানে যাবার পথে হার্ট ফেইল করে মারা গেছেন! এখন থেকে সেই দোকানে বসবে। আমি ভীষণ অবাক। কাউকে কোন পূর্ব সঙ্কেত না দিয়ে, সমস্ত দায়িত্ব ফেলে দিয়ে মানুষ এভাবেই চলে যায়! 

এরপরেও আমি কয়েকবার সেই দোকানে গিয়েছি। ছেলেটিকে আমি তার কলেজের বন্ধুদেরকে নিয়ে কাস্টমারদেরকে পাত্তা না দিয়ে খোশগল্পে মত্ত হতে দেখেছি। স্মার্ট ফোন, এমনকি আই ফোন নিয়েও কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু কিছুদিন পর বন্ধুরাও লাপাত্তা হয়ে গেছে। কারণ ছেলেটার শরীর থেকেও কিছু অদৃশ্য শিকড় বের হয়ে ক্রমশ তাকে স্থবির করে দিচ্ছিল। পৃথিবীতে কিছু কিছু সত্যি আছে যেগুলো দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। এটা তেমন এক সত্য। অতঃপর আমি তাকে দেখেছি বাবার মতন অনির্দেশ্য দৃষ্টিতে সামনের ছোট আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। এক সময়ে তার দৃষ্টিও হয়তোবা ক্রমশ ঘোলা হয়ে আসছিল! 

সেনাবাহিনী হতে অবসরের পর বাসস্থান পরিবর্তন করে প্রথমে সেনানিবাস রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায় এবং পরে মহাখালী ডি ও এইচ এস এর রেল লাইনের পাশে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। সারা রাত ধরে অসংখ্য দুরাগত ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শুনতাম। স্বপ্ন বা জাগরণ দুই সময়েই। স্বপ্নের মাঝে মধ্যে এই শব্দকে মাঝে মধ্যে ইসরাফিলের শিঙার আওয়াজ বলে মনে হতো। আমার অন্তরাত্মার ভেতরে শীতের স্থবিরতা বিরাজ করত। মনে হতো এক দিন আমরা সবাই স্থির হয়ে যাব। 

ডিসেম্বরের শেষ। মাত্র কয়েকদিন পরেই ২০১৭ সন এসে কড়া নাড়বে হৃদয়ের দরজায়। সে বছর শীত জমে নাই তখনও। তবুও দুই দিন পূর্বে সন্ধ্যার পর বনানী-কচুক্ষেত সড়কের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই চায়ের দোকানের কাছে চলে গেলাম। রাস্তাটাকে প্রশস্ত করার জন্য দোকানগুলোকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বটগাছটাকেও কেটে ফেলা হয়েছে। কোথাও সেই দোকানের চিহ্ন মাত্র নাই!

আকাশে প্রবল চাঁদ উঠেছে। ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে। চরাচরের সবকিছুই অপরূপ সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। শুধু বটগাছের প্রকাণ্ড গুড়িটা সন্ত্রাসীদের ছোরায় ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে হাত, পা, মুণ্ডুহীন হয়ে মরা জ্যোৎস্নায় নেয়ে ওঠা আলোআঁধারিতে শুয়ে আছে! রাস্তার ওপরে।

গাজীপুর কথা