ঢাকা,  সোমবার  ২০ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

কোরবানির প্রস্তুতিতে যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হয়

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৩ মে ২০২৪

কোরবানির প্রস্তুতিতে যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হয়

ফাইল ছবি

কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা কোরবানির নির্দেশ দিয়ে বলেন— ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা কাউসার: ২)

কোরবানির মতো পূণ্যময় ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সঠিক পরিকল্পনা জরুরি। নতুবা সামান্য ভুলের জন্য যদি কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যায় তখন শুধু গোশত খাওয়াই বাকি থাকবে।

প্রথমেই চাই নিয়তের পরিশুদ্ধতা। কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। অন্যকোনো নিয়তে কোরবানি সহিহ হবে না, আল্লাহর দরবারে গৃহীতও হবে না। (সুরা হজ: ৩৭; বুখারি: ০১; মুসনাদে আহমদ: ২২৯৮৪; খুলাসাতুল ফতোয়া: ৪/৩১৩)

কোরবানির প্রথম কাজটি হলো পশু কেনা বা নির্বাচিত করা। এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো- এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহিমাতুল আনআম।’ শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর বয়সের দিকটাও খেয়াল রাখা জরুরি। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা কোরবানির পশু ‘মুসিন্না’ ছাড়া জবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছয় মাস বয়সের ভেড়া-দুম্বা জবেহ করতে পারবে। (মুসিন্না হলো- পাঁচ বছর বয়সী উট, দুই বছরের গরু, মহিষ এবং এক বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা। (সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩; আবু দাউদ: ২৭৯৭; ইবনে মাজাহ: ৩১৭৯)

কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশতসম্পন্ন, নিখুঁত ও দেখতে সুন্দর হওয়া উত্তম। এছাড়া কোরবানির পশু হতে হবে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত। হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু দিয়ে কোরবানি হবে না। অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট; রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট; পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত, যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ ( ইবনে মাজাহ: ৩১৪৪)

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- যত্রতত্র কোরবানির পশুরহাট বসানো অনুচিত। বিশেষ করে  সড়ক-মহাসড়কে। এতে করে ঈদে ঘরমুখো মানুষকে ভীষণ যানজটের কবলে পড়তে হয়। এক্ষেত্রে সুন্দর সমাধান হলো- স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় পশুর হাটের জন্য সড়ক থেকে দূরত্বে জায়গা নির্বাচন করা। মনে রাখা জরুরি- ইসলামে কাউকে কষ্ট না দেয়ার জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কোনো প্রকারের কষ্ট না দেয়। (সহিহ বুখারি: ৬০১৮)

অনেকে কোরবানির পশুর সাথে ভালো ব্যবহার করেন না। এটি ঠিক না। মনে রাখতে হবে, কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই হলো ভালবাসার বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করা। তো যে পশুটাকে আপনি কোরবানি করবেন ভাবছেন তার প্রতি যদি আপনার ভালোবাসা না জন্মায় এবং তাকে কষ্ট দেওয়া হয় তো আপনি কী কোরবানি দিচ্ছেন? ইসলাম তো সেই পশুটিকেই কোরবানি করতে বলে, যে পশুটি আপনার সবচেয়ে আদরের। অনাদর ও অবহেলার সেই পশুর রক্ত প্রবাহিত করে আপনি দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করতে পারেন? অনেকে তো পশুকে ইনজেকশন,পাউডার ও নিষিদ্ধ পাম সেবন করিয়ে মোটাতাজাকরণের প্রক্রিয়া চালায়। যা নিশ্চিত প্রতারণা। ইসলামে প্রতারণাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ধোকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ ( সহিহ মুসলিম: ১০৬)

এছাড়াও পশুকে মোটাতাজাকরণপ্রক্রিয়ার ফলে শুধু যে পশুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, বরং এর গোশত খেয়ে মানুষের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। যা মানুষ হত্যার মতো অপরাধ। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনুল কারিমে অন্যায়ভাবে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ সম্পর্কে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)

পশু জবাইয় যেন শরিয়তসম্মত হয় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। জবাই করার সময় চারটি রগ কাটা জরুরি: ১. কণ্ঠনালি, ২. খাদ্যনালী, ৩. দুই পাশের মোটা রগ, যাকে ওয়াজদান বলা হয়। এই চারটি রগের মধ্যে যেকোনো তিনটি কাটা হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দুটি কাটা হয় তবে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (হেদায়া: ৪/৪৩৭)

শরিকে কোরবানি করলে অন্য শরিকদের উপার্জন ও নিয়তের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা রাখা উচিত। অন্যথায় নিজের কোরবানিটাই কবুল না হওয়ার আশংকা থেকে যায়। এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো- যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কোরবানি করবে, তাহলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরিকদের কারো কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরিক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯) তবে, নিয়ত অশুদ্ধের বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি হবে, শুধু তার কোরবানি হবে না। (সুরা বাকারা: ২৮৬)

কোনো শরিকের কোরবানির টাকা হারাম কি না সেটাও যাচাই করতে হবে। কারণ এর উপর নির্ভর করছে আপনার কোরবানি শুদ্ধ হচ্ছে কি না। এ ব্যাপারে মাসয়ালা হলো- জেনেশুনে হারাম উপার্জনকারীকে কোরবানির অংশীদার করলে অন্য শরিকদের কোরবানি সহিহ হবে না। (সুরা বাকারা: ৪২; মুসলিম: ১০১৫) তবে, বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি হবে, শুধু হারাম টাকার অংশীদারের কোরবানি হবে না। (সুরা বাকারা: ২৮৬)

পশু জবাইয়ে পরিবেশ যেন দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। যেখানে সেখানে জবাই করা, জবাইকৃত পশুর রক্ত, বর্জ ফেলে রাখা নিন্দনীয় অপরাধ। এর ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। সেজন্যই মানবতার ধর্ম ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আবু মালেক আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা (বাহ্যিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা) অর্জন করা হলো অর্ধেক ঈমান।’ (মুসলিম: ২২৩, তিরমিজি: ৩৫১৭, ইবনে মাজাহ: ২৮০)

তাই কোরবানির রক্ত এবং বর্জ্য আমরা যেখানে সেখানে না ফেলে রেখে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মাটিচাপা দিয়ে দিতে পারি এবং কোরবানির কাজ শেষ হলে রাস্তায় যেন কোনো রক্ত বা ময়লা আবর্জনা পড়ে না থাকে সেজন্য জবাইকৃত জায়গা পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দেয়াও প্র‍য়োজন। এত করে আমরা, আমাদের প্রতিবেশী এবং পথচারীরা বিভিন্ন রোগ সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা পাবো। সম্ভব হলে ব্লিচিং পাউডারও ছিটিয়ে দিতে পারি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।