ঢাকা,  শনিবার  ২৭ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

এভারেস্টের চেয়েও বড় বিশ্বের গভীরতম এই খাদ

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ১৮ জুলাই ২০২০

এভারেস্টের চেয়েও বড় বিশ্বের গভীরতম এই খাদ

যুগে যুগে দুনিয়া সাক্ষী হয়েছে ভালোবাসার নানা নিদর্শনে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের আগ্রার তাজমহল। মৃত স্ত্রীর স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল বানিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। এছাড়াও রয়েছে আরো উদাহরণ। 

আচ্ছা শুনেছেন কি? কেউ কখনো ভালোবেসে প্রিয়তমাকে পৃথিবীর গভীরতম খাদের জমিটুকু দিয়ে দেয়। হ্যাঁ, এমনটাই করেছিলেন রাজা চতুর্থ ফিলিপ। প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে নামকরণ করেছিলেন পৃথিবীর গভীরতম খাদের। যেটি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নামে পরিচিত। 

যদিও তখন রাজা জানতেনই না এটি যে গভীরতম এক খাদ। ১৬৬৮ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমের দ্বীপপুঞ্জে কলোনি স্থাপন করে স্পেনীয়রা। কেবল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি তারা। স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপের বিধবা স্ত্রী রানি ‘মারিয়ানা অব অস্ট্রিয়া’র নাম ধার নিয়ে দ্বীপের নামকরণও করা হয় ‘মারিয়ানা আইল্যান্ড’। এটি রাজার জীবদ্দশায় এক ইচ্ছা ছিল। তবে ঔপনিবেশিক শাসকরা নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারেননি মারিয়ানা আইল্যান্ডের দ্বীপগুলোর পূর্বপাশের জায়গাটিই পৃথিবীর গভীরতম স্থান।

 

রাজা চতুর্থ ফিলিপ ও রানি মারিয়ানা

রাজা চতুর্থ ফিলিপ ও রানি মারিয়ানা

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে এই দ্বীপগুলো আসলে ডুবে থাকা কিছু ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির চূড়া। এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ২০০ কি.মি. পূর্বে বিস্তৃত বিশ্বের গভীরতম মহাসাগরীয় খাত। ২৫৫০ কি.মি. লম্বা এবং ৬৯ কি.মি. চওড়া এই সামুদ্রিক খাতের নাম দেয়া হয়েছে নিকটবর্তী দ্বীপপুঞ্জের নামেই। ফলে গভীরতম খাত ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’এর পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে স্পেনের রানির নাম।

সমুদ্রবিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা গিয়েছে, এই খাতের গভীরতম অংশের মাপ ১০ হাজার ৯৮৪ মিটার। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম এই অঞ্চলের নাম দেয়া হয়েছে চ্যালেঞ্জার ডিপ। এর গভীরতা বোঝানোর জন্য বলা হয়, যদি মাউন্ট এভারেস্টকে এর মধ্যে বসিয়ে দেয়া যায়, তা হলে আরো প্রায় দুই কি.মি. বা এক দশমিক ছয় মিটারের মতো জায়গা বাড়তি পড়ে থাকবে। অর্থাৎ পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গের থেকেও আয়তনে বড় বিশ্বের গভীরতম খাত।

মারিয়ানা খাতের শেষ সীমায় তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করে এক ডিগ্রি থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। দীর্ঘ গবেষণার পর জানা যায়, প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ে সমুদ্রের তলদেশে শত শত বছরে সংগঠিত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে তৈরি হয়েছে মারিয়ানা প্লেট। দ্বীপগুলোর অবস্থান এসব প্লেটের ওপরেই। এই অংশে জলস্তম্ভের চাপও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে এই চাপের পরিমাণ প্রায় আট টন। 

 

গভীরতম খাদের নকশা

গভীরতম খাদের নকশা

সমুদ্রতলে স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপের তুলনায় এই পরিমাপ প্রায় হাজার গুণ বেশি। মারিয়ানা খাতে গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এই জলস্তম্ভের চাপ। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, পৃথিবীর অভ্যন্তরে যখন দুটি টেকটনিক পাতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, তখন একটি পাত দ্বিতীয়টির নীচে ঢুকে গেলে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো গভীর সামুদ্রিক খাতের সৃষ্টি হয়।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ নিয়ে মানুষের উৎসাহ বহু আগে থেকেই। প্রায় ১৫০ বছর আগে থেকেই তোড়জোড় চলে আসছে এর গভীরতা মাপার জন্য। ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৮৭৬ সালের মে মাসের মধ্যে বেশ কয়েকবার ‘চ্যালেঞ্জার এক্সপিডিশন’ নামের পরীক্ষামূলক অভিযানের মাধ্যমে গভীরতা মাপার চেষ্টা চালানো হয় খাদটির। ১৮৭২ সালের ২১ ডিসেম্বর অভিযান শুরু করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলীয় শহর পোর্টসমাউথ থেকে। 

ক্যাপ্টেন জর্জ নারেসের নেতৃত্বে অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। বিশাল এই এলাকায় সেই আমলে সীমিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযানটি সফল করতে সময় লাগে কয়েক বছর। তখন জানা যায়, খাদটির সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ২৬ হাজার ৮৫০ ফুট। অভিযানের প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ এবং সামুদ্রিক প্রাণীবিজ্ঞানী স্যার চার্লস ওয়াইভিল থমসন। 

 

গভীর এক খাদ

গভীর এক খাদ

১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বার মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপে ব্রিটিশ জাহাজ এইচ এম এস চ্যালেঞ্জার। পরে বহু বার বিশ্বের গভীরতম খাত নিয়ে গবেষণা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে এর গভীরতা সংক্রান্ত তথ্য। এরপর ১৮৯৯ সালে চালানো আরেক অভিযানে পাওয়া গেল নতুন তথ্য। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ প্রায় ৩১ হাজার ৬১৪ ফুট গভীর। 

বিজ্ঞানীরা সে আমলে খাদের গভীরতা মাপার জন্য ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের সাউন্ডিং মেশিন বা শব্দ উৎপাদক যন্ত্র। এরপর ১৯৩১ সালে সহজ এবং আগের তুলনায় নির্ভুলভাবে বিজ্ঞানীরা মাপার চেষ্টা করেন বিশ্বের সবচেয়ে গভীর স্থান আসলে কতটা গভীর। পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয় চ্যালেঞ্জার ২ নামের একটি জাহাজ। এতে চড়ে বিজ্ঞানীরা মারিয়ানা খাদের গভীরতা মাপেন ইকো সাউন্ডিং বা প্রতিধ্বনি গ্রহণ পদ্ধতিতে। 

সেই দুঃসাহসিক অভিযানে জানা যায়, খাদটির সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৫ হাজার ৭৫৭ ফুট। আজ পর্যন্ত মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষবিন্দুতে অসংখ্য অভিযাত্রীর পা পড়েছে। তবে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে পৌঁছতে পেরেছেন মাত্র নগণ্য সংখ্যক অভিযাত্রী। দুই অভিযাত্রী ছিলেন জাক পিকার্ড এবং মার্কিন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ডন ওয়ালশ। ১৯৬০ সালে মার্কিন নৌসেনার ব্যাথিস্কেপে সওয়ার হয়ে এই দুই দুঃসাহসী পৌঁছেছিলেন মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে। 

 

অন্ধকার খাদ

অন্ধকার খাদ

ব্যাথিস্কেপ হলো সমুদ্রের গভীরে অভিযান চালানোর জলযান। ডুবোজাহাজের সঙ্গে এর অনেকটাই বৈসাদৃশ্য আছে। সুইস ও ইতালীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত ব্যাথিস্কেপ ত্রিয়েস্তের সাহায্যে বিশ্বের গভীরতম বিন্দুতে অভিযান চালিয়েছিলেন এই দুজন অভিযাত্রী। সমুদ্রে ডুব দেয়ার পাঁচ ঘণ্টা পর তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তবে চ্যালেঞ্জার ডিপ-এর গভীর বিন্দুতে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র ২০ মিনিট। 

তারা খাদের মাত্র ১০ হাজার ৯১৬ মিটার পর্যন্ত নামতে পেরেছিলেন। তাদের যাত্রাপথে বা গভীরতম বিন্দুতে পৌঁছে কোনো ছবি তুলতেই পারেননি অভিযাত্রীরা। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে- এর মধ্যে তাদের যাত্রাপথ ঘিরে ছিল ক্লাউড অব সিল্ট। নিশ্চয় ভাবছেন, মহাসাগরের গভীরে মেঘ আসবে কীভাবে? আসলে এই মেঘ আকাশের জলীয় বাষ্প কণার সমষ্টি নয়। এ হলো বালি, কাদামাটি ও অন্যান্য উপকরণের সমষ্টি। যা পানির প্রবাহে ক্রমাগত জমতে থাকে মহাসগরের গভীর খাতে। সেই জমাটবদ্ধ বালি-কাদামাটির অংশকেই মেঘ বলে বর্ণনা করা হয়।

তবে খাদের গভীরে নিকষ অন্ধকার। তার উপর কাদামাটির জমাট মেঘ। ফলে অন্ধকার ভেদ করে ত্রিয়েস্তের আলো রহস্যভেদ করতে পারেনি। পিকার্ড বার বার দাবি করেন, তিনি গভীর খাতে একটি ফ্ল্যাটফিশ দেখেছিলেন। তবে তার দাবির সঙ্গে সহমত হতে পারেননি অধিকাংশ বিজ্ঞানী। তাদের মতে, জলস্তম্ভের অত চাপে কোনো প্রাণী জীবিত থাকতে পারে না। কারণ চাপের ফলে ক্যালসিয়াম দ্রবীভূত হয়ে যাবে। ক্যালসিয়াম গলে গেলে প্রাণীর হাড়ের গঠনও অসম্ভব।   

 

গভীর খাদের মিলেছে প্রাণের সন্ধান

গভীর খাদের মিলেছে প্রাণের সন্ধান

প্রকৃতি বারবার ভুল প্রমাণ করেছে বিজ্ঞানীদের ধারণাকে। গবেষক ও সমুদ্রবিজ্ঞানীদের ধারণা, চ্যালেঞ্জার ডিপসহ মারিয়ানা খাতের বহু অংশের নিকষ অন্ধকারে বহু রহস্য অপেক্ষা করে আছে বাইরের পৃথিবীর জন্য। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের বেশিরভাগ অংশের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের অনুমতি সাপেক্ষেই গবেষণা করা হয় বিশ্বের এই ভৌগোলিক বিস্ময়ে। 

বিজ্ঞানীদের ধারণা, খাদটি প্রায় ২৫৫০ কিলোমিটার (১ হাজার ৫৮০ মাইল) দীর্ঘ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য চওড়ায় এটি মাত্র ৬৯ কিলোমিটার (৪৩ মাইল)। এখনো পর্যন্ত খাদের সর্বোচ্চ গভীরতা জানা গেছে প্রায় ১১ কিলোমিটার (প্রায় ৩৬ হাজার ৭০ ফুট)! অবশ্য গভীর সাগরের তলদেশে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি এখনো। ফলে বিজ্ঞানীদের ধারণা খাদের গভীরতা আরো বেশি হতে পারে।

সেজন্যই তারা চালাচ্ছেন নিত্যনতুন অভিযান। প্রথম অভিযানের পরে অর্ধশতক পেরিয়ে ২০১২ সালে ফের মানুষের অবতরণ ঘটে মারিয়ানা খাতে। এবার সাব-ডাইভ দেন চিত্র পরিচাল জেমস ক্যামেরন। তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন ১০ হাজার ৯০৮ মিটার পর্যন্ত। একটুর জন্য বেঁচে যায় প্রথম দুই অভিযাত্রীর রেকর্ড। 

 

মারিয়ানা ট্রেঞ্জ

মারিয়ানা ট্রেঞ্জ

তবে সম্প্রতি আর এক অভিযাত্রী ভিক্টর ভেসকোভো পৌঁছেছেন ১০ হাজার ৯২৭ মিটার অবধি। তিনি প্রথম অভিযাত্রীদের রেকর্ড ভাঙতে পেরেছেন। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তুলনামূলক অগভীর অংশে অ্যাম্ফিপড এবং হলোথুরিয়ান্সের মতো সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। তবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, প্রাণীবিজ্ঞানের আরো অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে মারিয়ানা খাতের নিকষ অন্ধকারে। 

 মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর অংশটি শেষ হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে চ্যালেঞ্জার ডিপ নামের ভ্যালিতে গিয়ে। খাদের শেষ অংশে পানির চাপ এতটাই যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুচাপের তুলনায় তা হাজার গুণেরও বেশি! এ কারণেই এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির ঘনত্বও প্রায় পাঁচ শতাংশ বেশি। খাদের সবচেয়ে নিচু জায়গা চ্যালেঞ্জার ডিপ নামটি রাখা হয়েছে জলযান এইচএমএস চ্যালেঞ্জার-২ এর নাম অনুসারে। 

স্থানটির তাপমাত্রা এতই কম যে, বিজ্ঞানীরা বলেন সাগর তলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার স্থান এটিই। মারিয়ানা খাদে দেখা মিলেছে অতি ক্ষুদ্র কিছু ব্যাকটেরিয়ারও। সাধারণত সমুদ্রতলের গভীরে মৃত প্রাণীর কঙ্কাল, খোলস জমা পড়তে থাকে। মারিয়ানার তলও আলাদা নয়। এখানকার পানির রং সে জন্যই খানিকটা হলুদ। 

চরম এই পরিবেশে কী করে প্রাণীগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, সেই রহস্য জানা গেলে বায়োমেডিসিন ও বায়োটেকনলজির অনেক বন্ধ দরজা খুলে যাবে। বিজ্ঞানী মহলের আরো ধারণা, মারিয়ানা খাতের অন্ধকার ভবিষ্যতে আলো ফেলতে পারে পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টির রহস্যের উপরেও। তবে দূষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি এই গভীর বিন্দুও। গভীরতম খাদেও অভিযাত্রীরা পেয়েছেন প্লাস্টিকের নিদর্শন।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন