ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৮ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ঐতিহাসিক ১১ মার্চ এবং বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০০:৫২, ১০ মার্চ ২০২৩

ঐতিহাসিক ১১ মার্চ এবং বঙ্গবন্ধু

ঐতিহাসিক ১১ মার্চ এবং বঙ্গবন্ধু

বাঙালির ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেদিনের ধর্মঘটের মাধ্যমে আন্দোলন দানা বাধে ও বেগবান হয়- যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নাজিমুদ্দিন সরকার চুক্তি করতে বাধ্য হয় এবং আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বিরোধী দলের পক্ষে কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রস্তাবটির বিপক্ষে তীব্র সমালোচনা করে তা নাকচ করে দেন। সেদিন গণপরিষদের কোনো বাঙালি সদস্য প্রস্তাবটির পক্ষে কথা বলেননি।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঢাকায় ফিরে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে সংবর্ধনা দেয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রশিদ বিল্ডিংয়ে এক সভার মাধ্যমে সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সভায় ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২ মার্চ ফজলুল হক হলে আরেক সভার মাধ্যমে পরিষদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হয়, যেখানে তমদ্দুন মজলিস, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, গণ-আজাদী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল সংসদ, কলেজ প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১১ মার্চের ‘বাংলা ভাষার দাবি’ দিবসকে সফল করার লক্ষ্যে পরিষদ ৪ ও ৫ মার্চ সভায় মিলিত হয়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করে। নেতৃবৃন্দ জেলায় জেলায় বেরিয়ে পড়েন। শেখ মুজিব ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশাল ছাত্রসভা করে তিন দিন আগে ঢাকায় ফিরে আসেন।

১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা পরিষদের একটি সভা বসল। সভায় আপসকামীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। রাষ্ট্রভাষা পরিষদের অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছেন, আপস করতে চাইছেন সরকারের সঙ্গে। তখন শেখ মুজিব তার স্বভাবসুলভ দৃপ্তকণ্ঠে বলেন এবং সিদ্ধান্ত দেন-

“সরকার আপোষ প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে।”

ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, শওকত এবং শামসুল হক। অলি আহাদ তার এক স্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন-

“সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছাতেন তা হলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।”

১১ মার্চের ধর্মঘটে শেখ মুজিব সচিবালয়ে পিকেটিং করার সময় গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান সৃষ্টির সাত মাসপূর্তির আগেই তিনি গ্রেপ্তার হলেন। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার।

১১ মার্চের ঘটনা বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন-

…“১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের ছাত্রদের ওপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হয়। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেক দল হাজির হতে লাগলো। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার, এম এ ওয়াদুদ গুরুতর রূপে আহত হলেন। এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। আমাদের ওপর কিছু উত্তম-মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জীপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জীপে তুলে ফেলেছে । বহু ছাত্র গ্রেপ্তার ও জখম হল। কিছুসংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ৩০-৪০ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। আমাদের প্রায় ৭০-৮০ জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়।”…

এ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ওই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের সাহস-ত্যাগের চিত্র ফুটে উঠেছে।

ঢাকায় ১১ মার্চে সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে ১৫ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষায়তনগুলোতে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। প্রদেশের অন্যত্রও এ সময় হরতাল-ধর্মঘট চলতে থাকে। ১২ মার্চ এক বিবৃতিতে এ কে ফজলুল হক ছাত্রদের ওপর সরকারি দমননীতির নিন্দা করেন এবং পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্যদের পদত্যাগের আহ্বান জানান।

১৫ মার্চ দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল ও হরতালের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। উভয়পক্ষ বসে আট দফার একটি চুক্তির খসড়া তৈরি করেন। খসড়া চুক্তিটি নিয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেম ও কামরুদ্দিন আহমেদ কারাগারে বন্দী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। বন্দীদের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক ও অলি আহাদ খসড়া চুক্তিটি দেখে দেয়ার পর সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমেদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । ৮ দফার যে খসড়াটি অনুমোদন করেন তা ছিল নিম্নরূপ :

“১. ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে।

২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।

৩. ১৯৪৮ এর প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্বাচিত হইয়াছে সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাদিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।

৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়া স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল, কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে।

৫. আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হইবে না ।

৬. সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।

৭. ২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।

৮. সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।”

চুক্তি অনুযায়ী ১৫ মার্চ বিকেলেই ১১ মার্চ আটক হওয়া বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হয়। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সভায় যেসব চুক্তির ভিত্তিতে আপস হয়েছে একটা বাদে সবগুলো সভা অনুমোদন করল। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল অ্যাসেম্বলি হাউস অভিমুখে যায়।

মিছিলকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন অবস্থার অবনতি দেখে সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল কমান্ডিং অফিসার (জিওসি) ছিলেন মেজর জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি নিজেই এসেছিলেন আইন পরিষদ ভবনে।

১৯ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে আসেন। ২১ মার্চ বিকেলে তাকে রেসকোর্স ময়দানে এক গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। তার এক ঘণ্টার ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। এতে ছাত্ররা দারুণভাবে হতাশ হয়। তার বক্তৃতা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও ক্ষোভ প্রকাশ পায় বিচ্ছিন্নভাবে। এরপর ২৪ মার্চ সকালে জিন্নাহর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে পুনরায় ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ ঘোষণা দিলে সেখানেই কিছু সংখ্যক ছাত্র তরুণ ‘নো’ ‘নো’ বলে প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারণ করেন।

জিন্নাহ ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদের সরকারি বাসভবনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে পরিষদের পক্ষে শামসুল হক, মো. তোয়াহা, অধ্যাপক আবুল কাশেম, কামরুদ্দিন, নইমুদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়, যাতে বলা হয়েছিল ‘বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হউক’। এটাই ছিল জিন্নাহর প্রথম এবং শেষ ঢাকা সফর। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন তিনি আর কোনোদিন বলেননি ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে আসেন। ২৭ জানুয়ারি বিকেলে পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের এক জনসভায় তার ভাষণে জিন্নাহর মতো তিনিও ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এ ঘোষণা ছিল ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চের তার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বরখেলাপ। তার এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৮ সালের চাইতেও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন ইতিহাস ‘২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২’।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়