ঢাকা,  শনিবার  ০৪ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

তীব্র গরমে শিশু ও নবজাতকের যত্ন নেবেন কীভাবে?

প্রকাশিত: ১৫:৫৫, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

তীব্র গরমে শিশু ও নবজাতকের যত্ন নেবেন কীভাবে?

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে টানা কয়েকদিন ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আবহাওয়া অধিদফতর সোমবার দ্বিতীয় দফায় ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে।

বাতাস এত গরম যে এখন দিনের বেলায় ঘরের বাইরে পা রাখার উপায় নেই। আবার ঘরের ভেতরে যে খুব আরাম, বিষয়টি তেমনও না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপ শুধু ঘরের দেয়াল বা ছাদ না, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সবকিছুকে গরম করে ফেলছে।

গ্রীষ্মের এই অসহনীয় গরম থেকে স্বস্তি পেতে প্রাপ্তবয়স্করা একটু পর পর চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছেন, তৃষ্ণা পেলে পানি পান করছেন, রোদে বের হলে সঙ্গে ছাতা রাখছেন, রোদ চশমা ব্যবহার করছেন, কাজ করতে গিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু শিশু ও নবজাতকদের বেলায় কী হচ্ছে?

শিশুরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না যে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে তাদেরও কষ্ট হচ্ছে। তাই, গরমের সময় তাদেরকে বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষিত রাখতে অভিভাবকদের বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে।

প্রথমেই আমরা জেনে নিই শিশুদের গ্রীষ্মকালীন রোগ-বালাই

বছরের উষ্ণতম মাস এপ্রিলে শিশুরা সাধারণত ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগ, ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। এসময় হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভীড় থাকে।

‘এখন হাসপাতালে ১ হাজার থেকে ১২০০ রোগী আসে। আউটডোরে রোগীর চাপ অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগী। প্রচুর চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীও আসছে’, বলছিলেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ।

‘শিশুরা এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ, গরমের সময় ভাইরাসগুলো বেশি জন্মায়। এসময় খাবারে অল্পতেই পঁচন ধরে। সেই খাবার যখন কেউ খেয়ে ফেলে, তাহলে তার ডায়রিয়া হয়ে যায়’।

এছাড়া, ‘চর্মরোগ ছোয়াঁচে হওয়ায় ছড়ায় বেশি। গরমের জন্য বাচ্চাদের বাইরে বড়দেরও এটি হচ্ছে’।

ডা. আহমেদ জানান, গরমে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, প্যারাসাইটজনিত রোগ বাড়ে। কারণ তাপমাত্রার সঙ্গে এগুলোর সংক্রমণ বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক আছে।

ভাইরাল ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার বাইরেও বাংলাদেশে এইসময় চিকেন পক্স বা জলবসন্ত, রুবেলা, মাম্পস, স্ক্যাবিস বা খোঁসপাচড়া ইত্যাদি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।

‘স্ক্যাবিস খুব বেশি হয় এসময়। কিন্তু এর মূল কারণ, আমাদের দেশে ফাঙ্গাল ক্রিমের বেশিরভাগই তাদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অধিকাংশ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে’, তিনি যোগ করেন।

সংক্রমণজনিত ছোঁয়াচে রোগ ছাড়াও শরীর থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় ঘাম বেরিয়ে যাওয়ায় তীব্র গরমে শিশুরা হিটস্ট্রোকেও আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া, গরমে অনেক শিশুর ঘামাচিও দেখা দেয়।

শিশু ও নবজাতকরা যাতে এই ধরনের রোগ-বালাইতে আক্রান্ত না হয়, তাই বাবা-মায়েদেরকে কিছু বিষয়ে এখন থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক আহমেদ।

সূর্যের আলো থেকে ‘নিরাপদ দূরত্ব’

শিশুরা ঘরের বাইরে যেতে বা খেলাধুলা করতে পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে এটা সবার আগে মনে রাখা প্রয়োজন যে গরমের সময় শিশুদেরকে নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ালে তাদের খুব সহজেই হিটস্ট্রোক বা ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সেজন্য ‘শিশুদের জন্য ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা’ করার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. আহমেদ।

ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এনএইচএস বলছে, ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখা উচিৎ। প্রাপ্তবয়স্ক শিশুদেরকেও গ্রীষ্মকালীন রোদ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা প্রয়োজন। বিশেষ করে, বেলা ১১টা থেকে বিকেল তিনটার সময়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এন্ড মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি দ্বারা ১৮ বছরের নীচের শিশুদের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

সেজন্য যদি কোনো কারণে শিশুদেরকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সানস্ক্রিন ও সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষা দেবে, এমন পোশাক পরানো উচিৎ। সেইসঙ্গে, তাদেরকে ছাতার নীচে রাখতে হবে।

নিরাপদ পানি ও পানিজাতীয় খাবার

শরীরে যাতে পানিশূন্যতা দেখা না দেয়, তাই গরমের সময় তরল খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তবে ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের পানি পান করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তাদেরকে এসময় ‘আর্টিফিশিয়াল মিল্ক না দিয়ে ব্রেস্ট ফিডিং’ করানোর পরামর্শ দিয়েছেন ডা. আহমেদ।

গরমের সময়ে শিশুদেরকে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি বুকের দুধ পান করাতে বলছে এনএইচএসও। তবে যেসব শিশুরা মায়ের বুকের দুধের বাইরে অন্য ‘সলিড’ খাবারও গ্রহণ করতে পারে, তাদেরকে বুকের দুধের পাশাপাশি বোতলে করে প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি ও পানি জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে।

দিনে শিশুকে কতটুকু পানি খাওয়াতে হবে, এ প্রসঙ্গে ডা. আহমেদ বলেন যে ‘বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী তাকে পানি খাওয়াতে হবে’। এক্ষেত্রে, একজন পেশাগত স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া ভালো।

তবে জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এন্ড মেডিসিনের তথ্য বলছে, ৬ মাসের বেশি বয়স যাদের, তাদের দৈনিক অর্ধেক থেকে এক কাপ পরিমাণ পানি পান করা উচিৎ।

যাদের বয়স ১ থেকে ২ বছর, তাদের জন্য দৈনিক চার কাপ ও স্কুলে যায় এমন শিশুদের দৈনিক আট কাপ পরিমাণ পানি পান করা উচিৎ। বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুদের বেলায় এটি দৈনিক ৮ থেকে ১২ কাপ।

এছাড়া, যারা প্রাপ্তবয়স্ক শিশু, তাদেরকে এ সময় ফল, ফলের শরবত, সালাদ ইত্যাদি খাওয়ানো উচিৎ। যেমন, তরমুজ। তরমুজ এমন একটি ফল, যার ৬০-৭০ শতাংশই হলো পানি।

এর বাইরে গরমে শিশুর দুর্বলতা কাটাতে মাঝে মাঝে তাকে খাওয়ার স্যালাইন খেতে দেয়া যেতে পারে।

শিশুর জন্য সুষম খাবার

চলমান তাপপ্রবাহের কারণ বাংলাদেশে যদিও এখন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কিন্তু স্কুল খোলার পর শিশুরা যেম বাইরের খাবার না খায়, শিশুর বাবা-মাকে সেদিকে মনযোগী হতে বলেছে ডা. আহমেদ।

কারণ বাইরের ফুচকা, চটপটি কিংবা ফাস্টফুড খেলে সেখান থেকে ডায়রিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়। তাই, এসময় শিশুদেরকে যতটা সম্ভব ‘ফ্রেশ খাবার’ খাওয়াতে বলেন তিনি।

মূলত, একটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তার খাদ্যতালিকায় প্রোটিন, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ইত্যাদি সঠিক পরিমাণে থাকা জরুরি।

তাই, এসময় শিশুদেরকে মৌসুমি ফলমূলের পাশাপাশি সহজপাচ্য বা সহজে হজমযোগ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়াতে হবে। যেমন- দুধ, ডিম, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি।

তবে গরমের সময় এমনিতেই শিশুরা খেতে চায় না। সেজন্য তাদেরকে যদি প্রতিদিন একই খাবার খাওয়ানো হয়, তাহলে অনেক শিশুর খাবারের ওপর অনীহা চলে আসতে পারে। সেজন্য বাবা-মাকে ধৈর্য ধরে মজাচ্ছলে নতুন নতুন উপায়ে তাদের সন্তানকে খাওয়াতে হবে।

এর বাইরে শিশুর শরীর ঠাণ্ডা করার জন্য তাকে কোনোভাবেই আইসক্রিম দেওয়া যাবে না। কারণ গরমে আইসক্রিম খেলে তা দেহে পানিশূন্যতা বাড়িয়ে তোলে।

আরামদায়ক ঘর

বর্তমানে প্রায় সারাদেশে বিদ্যুৎ থাকায় সবার বাড়িতেই ফ্যান কিংবা এসির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু গরমের সময় বিদ্যুতের চাহিদার যোগান দিতে না পারায় প্রচুর লোডশেডিং হয়। বিশেষ করে, গ্রামে।

তাই, গরমের সময় শিশুর যাতে হিটস্ট্রোক না হয়, সেজন্য ঘরে প্রাকৃতিকভাবেই আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য কিছু পরামর্শ দেন অধ্যাপক আহমেদ। সেগুলো হলো —

দিনের বেলা সকালে ১০টার পর যখন আস্তে আস্তে রোদ উঠে, তখন ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ ঘরের বাতাসের চেয়ে বাইরের বাতাস বেশি গরম। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সন্ধ্যার সময় আবার ঘরের জানালা দরজা খুলে দিতে হবে।

> ঘরের বিভিন্ন কোণে গামলার মাঝে বরফ রেখে যদি পানি রাখা হয়, তাহলে রুমগুলো থেকে আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমে যাবে।

ঘরের জানালাগুলোয় শাড়ি বা কাপড় ভিজিয়ে রাখতে হবে। এটা তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

> বাথরুম ও রান্নাঘরে এক্সস্ট ফ্যান ব্যবহার করা উচিৎ। তাহলে তাপমাত্রা বাড়ে না।

শিশুকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা

গরমকালে শিশুর পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা জরুরি। এ সময় তাদেরকে সাবান দিয়ে নিয়মিত গোসল করাতে হবে এবং গোসলের পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার শরীর মুছিয়ে দিতে হবে।

এসময় তাকে ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ ধুলাবালি থেকে তাদের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। আর অতিরিক্ত গরমে শিশু বারবার ঘেমে গেলে অবশ্যই একটি পাতলা কাপড় বা গামছা দিয়ে বারবার তার ঘাম মুছে দিতে হবে। কারণ ঘাম যদি শরীরেই শুকিয়ে যায়, তাহলে তা থেকে তার জ্বর হতে পারে।

শিশুর পোশাক

গরমকালে শিশু কী ধরনের পোশাক পরছে, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুদেরকে ঢিলেঢালা পাতলা সুতি কাপড় পরানোর ও নবজাতকদেরকে কাপড়ে মুড়িয়ে না রাখার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। সবচেয়ে ভালো হয় সাদা কাপড় পরালে।

কারণ শিশুর শরীরে র‍্যাশ এড়াতে বা ঘামাচির কষ্ট লাঘব করতে এটা সহায়ক। কিন্তু এসময় প্রচুর মশা ও পোকামাকড় বেড়ে যায়। ফলে শিশুদের শরীর সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখবে, এমন পাতলা জামা পরানো যেতে পারে। নবজাতকদের বেলায় এটি না করে তাদেরকে মশারির নীচে রাখা যেতে পারে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা