ঢাকা,  শনিবার  ০৪ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

জমি বন্ধক রেখেও বাঁচাতে পারেননি ছেলেকে, ঋণের বোঝায় নিঃস্ব পরিবার

প্রকাশিত: ১১:৩২, ২ মে ২০২৩

জমি বন্ধক রেখেও বাঁচাতে পারেননি ছেলেকে, ঋণের বোঝায় নিঃস্ব পরিবার

সংগৃহিত ছবি

স্বপন কুমার মিস্ত্রি পেশায় একজন কৃষক। বয়স তার ৬০ এর ঊর্ধ্বে। বয়সের ভারে ভেঙে পড়েছেন অনেকটা। তার উপরে ক্যান্সার আক্রান্ত বড় ছেলে সুমন কুমার মিস্ত্রির চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে নিজেরসহ ভাইদের কৃষি জমিও বর্তমানে বন্ধকের তালিকায়। কিন্তু বিধিবাম নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি সেই ছেলেকে। বড় ছেলের অসময়ে মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এর মাঝে ঋণের বোঝায় নিঃস্ব পরিবারটি। বর্তমানে অবস্থার উন্নয়নে সরকারিভাবে সহযোগিতা দাবি জানিয়েছে পরিবারটি।

জানা যায়, পিরোজপুর সদর উপজেলার ১নং শিকদার মল্লিক ইউনিয়নের শিকদার মল্লিক গ্রামের বাসিন্দা স্বপন কুমার মিস্ত্রি। বড় ছেলে সুমন কুমার মিস্ত্রি (৩০) বিয়ে করেছেন বছর ৩ আগে। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের একটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে চাকরি ছেড়ে ফিরেছিলেন বাড়িতে। অসুস্থতার এক পর্যায়ে সুমনের শরীরে ধরা পরে মরণব্যাধি প্রস্টেট ক্যান্সার। সেই থেকেই সব কিছু ভুলে নিজেদের সকল সামর্থ্য দিয়ে খুলনা, ঢাকা ও কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বড় ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন কৃষক বাবা স্বপন কুমার মিস্ত্রি। তবুও বাঁচাতে পারলেন না ছেলেকে। গত শনিবার (২২ এপ্রিল) দুপুরে নাজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুমনের মৃত্যু হয়। অসময়ে এমন চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না সুমনের স্ত্রীসহ পরিবার। এখন পরিবারে চলছে শোকের মাতম।

এদিকে সুমনের চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া নিজের ২০ শতাংশ জমিসহ ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে তাদের প্রায় ৮০ শতক কৃষি জমিও বন্ধক রেখেছেন মৃত সুমনের বাবা স্বপন। সুমনের চিকিৎসায় তিনি খরচ করেছেন প্রায় ৮ লক্ষাধিক টাকা। এর কিছু ঋণ পরিশোধ করতে পারলেও বর্তমানে বাকি টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে তারা। এমন অবস্থায় সরকারি বিশেষ কোনো সহযোগিতা ছাড়া নিঃস্ব হয়ে পড়েছে সুমনের পরিবার। যদি সরকারিভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো হয় তবে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর আশা পরিবারটির।

সুমনের বাবা কৃষক স্বপন কুমার মিস্ত্রি বলেন, আমার বড় ছেলে সুমন ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিল দুই বছরের বেশি সময়। তার চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছে হাত পেতেছি, অনেক ঋণ হয়ে গেছে। আমার জায়গা-জমি যতটুকু ছিল সেগুলো বন্ধক রেখে চিকিৎসা করিয়েও কোন কূল-কিনারা হয়নি। সে আমাদের ছেড়ে অল্প সময়েই পৃথিবী থেকে চলে গেল। কিন্তু আমাদের তো আর চলছে না। আমার বয়স বর্তমানে ৬৪-৬৫ বছর। বয়সের ভারে কাজ করতে পারি না তেমন। কীভাবে যে এই ঋণ শোধ করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার পরিবার তো শেষ, একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছি। ছেলে বিয়ে দিয়েছি, ছেলের বউ অসহায়ের মত সামনে ঘুরে বেড়ায়। এখন সরকারিভাবে যদি আমার পরিবারকে একটু সহযোগিতা করা হয় তাহলে আমরা একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারি।

সুমনের স্ত্রী সুকলা রাণী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে তিন বছর। বিয়ের পর থেকেই স্বামী অসুস্থ। পরে তার শরীরে ধরা পড়ে ক্যান্সার। আমরা পরিবার থেকে তার সেবা-যত্ন বা চিকিৎসার কোনো কমতি রাখি নাই। কলকাতা পর্যন্ত নিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি, আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে।

মৃতের চাচা রতন কুমার মিস্ত্রি বলেন, আমার বড় ভাইয়ের বড় ছেলে সুমন। সে প্রায় আড়াই বছরের মতো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিল। ঢাকা-খুলনা-কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় তাকে চিকিৎসা করানো হয়েছে। তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। বিশেষ করে জমিজমা আমাদের খুব বেশি নেই, তাও যতটুকু ছিল তা বন্ধক দিয়ে চিকিৎসার খরচ চালিয়েছি। সুমন তো অসময়ে চলে গেল, আর আমরা এখন দুঃখের সাগরে ভাসছি। তার ওপর পরিবারের এই অবস্থা। সরকারের কাছে আমরা আবেদন, যদি কোনোভাবে পরিবারটিকে একটু সহযোগিতা করে বাঁচিয়ে রাখা যায়। সুমনের স্ত্রীকে যদি কোথাও একটু চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। তাহলেও অন্তত পরিবারটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তাতে আমরা সরকারের প্রতি আসলেই অনেক কৃতজ্ঞ থাকব।

সুমনের প্রতিবেশী ভবতোষ বলেন, এদের সম্পত্তি বলতে যা আছে তা খুবই সামান্য। সুমনের বাবা-চাচারা মিলে পাঁচ ভাই। তার বাবা স্বপন বছরের বেশিরভাগ সময় নিজের কিছু জমিতে কৃষি কাজের পাশাপাশি মানুষের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালায়। সর্বশেষ ক্যান্সারে আক্রান্ত বড় ছেলের চিকিৎসায় সর্বহারা হয়েছে পরিবারটি। তাদের চলার মতো এখন আর কোনো পথ নেই।

এ বিষয়টি সম্পর্কে পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমানকে অবহিত করা হলে তিনি বলেন, আমি স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে সুমন ও তার পরিবারের বিষয়টি শুনেছি। তারা জেলা প্রশাসক বরাবর সহযোগিতার জন্য একটি লিখিত আবেদন করলে আমি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে পরিবারটিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও সহযোগিতা আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।