ঢাকা,  শনিবার  ০৪ মে ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

অসুস্থ স্বামী-সন্তান, ৫ জনের সংসার চালান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারেছা

প্রকাশিত: ১১:২২, ১৬ এপ্রিল ২০২৩

অসুস্থ স্বামী-সন্তান, ৫ জনের সংসার চালান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারেছা

সংগৃহিত ছবি

চোখের আলো না থাকলেও মনের আলোয় সংসার আলোকিত করে রেখেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গৃহবধূ পারেছা খাতুন। নিজে অন্ধ হয়েও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই শিশু সন্তান, মানসিক ভারসাম্যহীন ননদ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্বামী ও বৃদ্ধা দাদি শাশুড়িকে নিয়ে চলছে তার জীবন সংগ্রাম। 

অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া পারেছা খাতুন মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কাজিপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দিনমজুর শাহীনের স্ত্রী। নিজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও হাল ছাড়েননি সংসারের। পারেছাই তার সংসারের প্রধান।

জানা গেছে, জন্ম থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারেছা খাতুন। ১০ বছর আগে তার বিয়ে হয় মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী শাহীনের সঙ্গে। তার দুই সন্তানের মধ্যে সাত বছর বয়সী ছেলে পারভেজ ও চার বছর বয়সী ছোট ছেলে হামিমও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সমবয়সী ননদ রঙ্গিলা আর বৃদ্ধা দাদি শাশুড়িকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার তার। চোখের আলো না থাকলেও মনের আলোয় পথচলা শুরু করেন তিনি। স্বামী শাহীনকে রাজমিস্ত্রির যোগাল হিসেবে কাজে পাঠিয়ে আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বাড়িতে। শাহীন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার মজুরি দেওয়া হয় অর্ধেক। এই সামান্য টাকা দিয়ে সংসার চালানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হওয়ায় পারেছা খাতুন শুরু করেন ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন। এ দিয়ে কোনোরকমে দিন কাটে অসহায় ওই পরিবারটির।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারেছা জানান, নিজে অন্ধ হওয়ায় মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামীর সঙ্গে সংসার পাতেন তিনি। সংসার শুরুর বছর খানেকের মধ্যে প্রথম ও তার তিন বছর পরে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলেও বিধি বাম, সন্তান দুজনও অন্ধ। ফলে দুঃখের সংসারে নেমে আসে আরও কষ্ট। তবুও হাল ছাড়েননি পারেছা খাতুন। ভিক্ষাবৃত্তি না করে পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছে। নিজের হাতে সংসারের সব কাজ করতে হয় তাকে। রান্নাবান্না, সন্তানদের গোসল করানো খাওয়ানো ছাড়াও সংসারের সব কাজই করেন নিপুণ হাতে। ঝুপড়ি একটি ঘরে তাদের বসবাস।

স্থানীয় ও প্রবাসী কয়েক যুবক মিলে কোনো রকম থাকার ঘরটি ঠিক করে দিয়েছেন। তারপরও এখন দৃষ্টিহীন দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে কূলকিনার পাচ্ছেন না। এভাবেই সংগ্রাম করে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন পারেছা।

প্রতিবেশী তোহমিনা খাতুন বলেন, আমরা স্বাভাবিক মানুষই ঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না। অথচ পারেছা অন্ধ হয়েও রান্না করা, ঘর গোছানো, গরু-ছাগল পালনসহ সংসারের সব কাজ নিজ হাতে করে। 

আরও এক প্রতিবেশী রহমাত আলী জানান, পারেছা অন্ধ, তার ছেলে দুটিও অন্ধ। স্বামীটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, ননদ আছে সেও মানসিক ভারসাম্যহীন। এদের একটি সরকারি ঘর দিলে অনেক ভালো হতো।

স্থানীয় সোহেল রানা বাবু জানান, সংসারটির সবাই প্রতিবন্ধী। তারপরও কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের খোঁজখবর নেয় না। সরকারি কোনো অনুদানও তাদের কাছে পৌঁছাত না। একটি ঝুপড়ি ও ভাঙাচোরা টিনের ঘরে তাদের বসবাস। আমরা কয়েকজন মিলে প্রবাসীদের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে পারেছার বসবাসের ঘরটি মেরামত করে দিয়েছি। এরাই মুজিব শতবর্ষেও ঘরের দাবিদার। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। সরকারের জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে একটি বাড়ি করে দেওয়া হলে অসহায় মানুষগুলো ভালো থাকত।

স্থানীয় ইউপি সদস্য রেজাউল হক বলেন, আমি ব্যক্তিগত ও সরকারি সহায়তা থেকে পরিবারটিকে কিছু সহায়তা দিয়েছি। তবে তা যথেষ্ট নয়। সরকারি কোনো অনুদান পেলে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

স্থানীয় কাজিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলম হুসাইন জানান, আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সব সুযোগ-সুবিধা পারেছা পেয়ে থাকেন। তাদের নামেও সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড রয়েছে। তাছাড়া ভিজিডি, ভিজিএফ, টিসিবিসহ সব সহায়তায় তাদের দেওয়া হয়। মানবিক কারণে আমি ব্যক্তিগত ভাবেও পারেছার সংগ্রাম দেখে সহযোগিতা করি। 

গাংনী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আরশাদ আলী বলেন, পরিবারটি সম্পর্কে আমাদের জানা রয়েছে। পারেছার নামে প্রতিবন্ধী ভাতা চালু রয়েছে। তার দুই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলেদের প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজিয়া সিদ্দিকা সেতু বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারেছার অদম্য ইচ্ছাশক্তি সত্যিই প্রশংসনীয়। নিজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও পুরো একটি সংসারকে আলোকিত করে রেখেছে।