ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

২৫ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

২৫ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন

২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সাল। বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন। ইতিহাস কাঁপানো এক শ্রেষ্ঠ ভাষণ ছিল এটি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পিচঢালা পথে নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাংলার ছাত্র-জনতা। এর ২২ বছর পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আবার সমুন্নত হয় বাংলা ভাষার মর্যাদা। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিহাস গড়েন। সেদিনের পর জাতিসংঘে অনেকেই বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দেন।

ঐতিহাসিক এ দিনটির সূচনা হয় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, 'আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।' 

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর সফরসূচি ঠিক করা হয়। সেই হিসাবে ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধু তার ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীদের নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। সফরসঙ্গীর মধ্যে ছিলেন- পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর পলিটিকাল সেক্রেটারি তোফায়েল আহমেদ, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও অয়েল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, এমআর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আরও অনেকে। 

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।' কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।'  বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।

ভাষণের শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনদানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যাঁহাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্বসমাজে স্থান লাভ করিয়াছে এই সুযোগে আমি তাঁহাদেরকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়ের মিলিত সংগ্রাম। জাতিসংঘ গত ২৫ বছর ধরিয়া এই শান্তি ও ন্যায়ের জন্যই সংগ্রাম করিয়া যাইতেছে।’

বঙ্গবন্ধু ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বন্ধু আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদীনের অবদানের কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া গুটি কয়েক মানুষের অপ্রত্যাশিত সমৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু এর যুক্তিসঙ্গত সমাধান দাবি করেন। বঙ্গবন্ধু আঞ্চলিক `জোন` গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রসঙ্গেও কথা বলেন তাঁর ভাষণে।

মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর অধিবেশনে সমাগত পাঁচটি মহাদেশের প্রতিনিধি এবং সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের 'ডেলিগেট বুলেটিন' বঙ্গবন্ধুকে 'কিংবদন্তির নায়ক মুজিব' বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কের প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া পত্রস্থ করা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, 'এ যাবৎ আমরা কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব।' জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, 'বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎ কণ্ঠ।' জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ।'  বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান এই ভাষণ সম্পর্কে বলেন, ‘এটি ছিল একটি শক্তিশালী ভাষণ।’ কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভাষণকে `ইতিহাসের এক অবিচ্ছিন্ন দলিল` হিসেবে অভিহিত করেন।

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা যখন জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সারা বাংলাদেশ গর্বিত হয়ে উঠেছিলো সেদিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যের ভেতরও বাঙালি চিত্ত গৌরবের অংশীদার হয়ে উঠেছিল। বাঙালি যেন জগত্সভায় ঠাঁই পেল। যে ভাষণে তিনি তাঁর দেশ ও তাঁর জাতির সংগ্রামের ইতিহাস, দৃঢ়তা এবং প্রত্যয়ের কথা সকলকে শুনিয়ে এই জাতিকে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছিলেন।

গাজীপুর কথা