ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১৬:২৪, ২৪ জুলাই ২০২০

স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ

করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের নানা কেলেঙ্কারি আর বিতর্কের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মহামারির শুরুতে নানা পদক্ষেপে অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসকদের সুরক্ষাসামগ্রীর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন স্বাস্থ্য সচিবসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জেকেজি ও রিজেন্টকাণ্ডে সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) পদত্যাগ করার পর সেই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন আরেকজনকে। এ ছাড়া পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. আমিনুল হাসানকে ওএসডি করে সেখানেও নতুন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে যাচ্ছে। শক্তিশালী এই টাস্কফোর্সের মাধ্যমে দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ অন্যান্য চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে কোনো অনিয়ম হয় কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনে তোলপাড় চলছে। এ অবস্থায় একই ধরনের অভিযোগ থাকায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকও পদত্যাগ করতে পারেন বলে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি মন্ত্রী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে খুব শিগগিরই আরও পরিবর্তন আসছে বলে কর্মকর্তারা জানান। একই সঙ্গে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধেও ধারাবাহিকভাবে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের দেওয়া পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে সরকার। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার এক আদেশে বলেছে, ‘ডা. আজাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সঙ্গে সরকারের সম্পাদিত চুক্তিপত্রের অনুচ্ছেদ-৭ অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে তার চুক্তিভিত্তিকক নিয়োগ গত ২১ জুলাই থেকে বাতিল করা হলো।’
অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. আবু রায়হান মিঞা স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, তিনি অনতিবিলম্বে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করবেন।
খুরশীদ আলম স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন, যাকে নানা কেলেঙ্কারি আর বিতর্কের মধ্যে ওই পদ ছাড়তে হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একের পর এক কেলেঙ্কারিতে সমালোচনার মুখে গত ২১ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন ডা. আজাদ। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদে ছিলেন তিনি। চাকরির মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ তাকে দুই বছরের চুক্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশে বলা হয়েছিল, ১৫ এপ্রিল বা যোগদানের তারিখ থেকে তিনি দুই বছরের জন্য মহাপরিচালকের দায়িত্ব থাকবেন। সেই হিসেবে, আগামী বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তার চুক্তির মেয়াদ ছিল। তবে তার আগেই তাকে সরে যেতে হল। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় নানা অনিয়ম নিয়ে এর আগে কথা উঠলেও তাতে সমস্যায় পড়তে হয়নি আবুল কালাম আজাদকে। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের একের পর এক কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ হতে থাকলে তাকে বিপাকে পড়তে হয়। শুরুটা হয়েছিল চিকিৎসকদের নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ দিয়ে। এরপর রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজি হেলথ কেয়ারের জালিয়াতি ফাঁস হওয়ার পর তোপের মুখে পড়েন ডা. আজাদ। এক পর্যায়ে তিনি রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগ তুলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধেও জড়ান। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও দুই-তিন বছর থাকবে বলে এক বক্তব্যের জন্য মন্ত্রীদের তোপেও মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। পরে তিনি সেই বক্তব্য নিয়ে ‘বিভ্রান্তির’ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাজ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে আসছেন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা, যার দায় অধিদফতরে মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের ওপর বর্তায়। গত মে মাসে তাকে সিএমএইচেও ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। সম্প্রতি বিশ^ ব্যাংকের অর্থায়নে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নেওয়া দুটি প্রকল্পেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, এ প্রকল্পে গগলস ও পিপিইর দাম বাজারমূল্যের কয়েকগুণ বেশি ধরা হয়েছে। এ ঘটনার পর গত মাসে প্রকল্পের পরিচালককে বদলি করে সরকার। মহামারির মধ্যে নানা অভিযোগ ওঠায় এর আগে স্বাস্থ্য সচিবসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার ধারাবাহিকতায় এবার আবুল কালাম আজাদকে বিদায় নিতে হলো। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ডা. আজাদ অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা আবুল কালাম আজাদ ২০০১ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯০ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়) থেকে এমফিল ডিগ্রি নেন তিনি। আবুল কালাম স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের পরিচালক এবং অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) দায়িত্বও পালন করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ওএসডি : স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. আমিনুল হাসানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। অন্যদিকে তার স্থলে নিয়োগ পেয়েছেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপ-পরিচালক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা। এই রদবদল এনে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে আদেশ জারি করা হয়েছে। আদেশে বলা হয়, আমিনুল হাসানকে পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। এই দুই কর্মকর্তাকে বদলি করা স্থানে আগামী তিন দিনের মধ্যে যোগ দিতে বলা হয়েছে, অন্যথায় তারা চতুর্থ দিনে বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত (স্ট্যান্ড রিলিজ) বলে গণ্য হবেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে গুজব : এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের মতো একই ধরনের অভিযোগ থাকায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকও পদত্যাগ করতে পারেন বলে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি মন্ত্রী। তবে বৃহস্পতিবার সচিবালয়সহ বিভিন্ন মহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে খোঁজ নিলে তারা বলেন, এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না। কোনো কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি গুজব বলে জানান।

তবে কেউ কেউ মনে করছেন, যেকোনো সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন অথবা তাকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। অবশ্য সচিবালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েক দিন ধরেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী পদে পরিবর্তন আসার বিষয়ে গুঞ্জন চলছে। এমনকি কেউ কেউ বলছেন, ভেতরে ভেতরে নতুন মন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে।

গাজীপুর কথা