ঢাকা,  শনিবার  ২০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

সুদের অবৈধতা, ভয়াবহতা ও কুফল

প্রকাশিত: ১৩:১৮, ৪ অক্টোবর ২০২০

সুদের অবৈধতা, ভয়াবহতা ও কুফল

সুদের কারণে মিথ্যা মোহ, কর্মবিমুখতা, অশান্তি, অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সামাজিক ঘৃণা ছড়ায়। এতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং বিনিয়োগ হ্রাস পায়। 

মানবরচিত অর্থব্যবস্থায় সুদের জয়গাথা শোনা গেলেও যুগে যুগে এবং দেশে দেশে সুদের সুস্পষ্ট কুফল প্রমাণিত।

পবিত্র কোরআনুল কারিম ও হাদিসে সুদের অবৈধতা, ভয়াবহতা ও কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো-

الَّذِيۡنَ يَاۡكُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا يَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا كَمَا يَقُوۡمُ الَّذِىۡ يَتَخَبَّطُهُ الشَّيۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ‌ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَيۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا‌ۘ‌ وَاَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ الرِّبٰوا‌ؕ فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَةٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰى فَلَهٗ مَا سَلَفَ وَاَمۡرُهٗۤ اِلَى اللّٰهِ‌ؕ وَمَنۡ عَادَ فَاُولٰٓٮِٕكَ اَصۡحٰبُ النَّارِ‌ۚ هُمۡ فِيۡهَا خٰلِدُوۡنَ

অর্থ: ‘কিন্তু যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থায় উপনীত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলে, ‘ব্যবসা তো সুদেরই মতো।’ অথচ আল্লাহ‌ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির কাছে তার রবের পক্ষ থেকে এই নসীহত পৌঁছে যায় এবং ভবিষ্যতে সুদখোরী থেকে সে বিরত হয়, সে ক্ষেত্রে যা কিছু সে খেয়েছে তাতো খেয়ে ফেলেছেই এবং এ ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ হয়ে গেছে। আর এই নির্দেশের পরও যে ব্যক্তি আবার এই কাজ করে, সে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে সে থাকবে চিরকাল।’ (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৭৫)।

يَمۡحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَيُرۡبِىۡ الصَّدَقٰتِ‌ؕ وَاللّٰهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ اَثِيۡمٍ

অর্থ: ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত ও বিকশিত করেন। আর আল্লাহ‌ অকৃতজ্ঞ দুষ্কৃতকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৭৬)।

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا اتَّقُوۡا اللّٰهَ وَذَرُوۡا مَا بَقِىَ مِنَ الرِّبٰٓوا اِنۡ كُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِيۡنَ

অর্থ: ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও, যদি যথার্থই তোমরা ঈমান এনে থাকো।’ (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৭৮)।

فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا فَاۡذَنُوۡا بِحَرۡبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَرَسُوۡلِهٖ‌ۚ وَاِنۡ تُبۡتُمۡ فَلَكُمۡ رُءُوۡسُ اَمۡوَالِكُمۡ‌ۚ لَا تَظۡلِمُوۡنَ وَلَا تُظۡلَمُوۡنَ

অর্থ: ‘কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না করো তাহলে জেনে রাখো, এটা আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এখনো তাওবা করে নাও (এবং সুদ ছেড়ে দাও) তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের ওপর জুলুম করাও হবে না।’ (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৭৯)।

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡكُلُوۡا الرِّبٰٓوا اَضۡعَافًا مُّضٰعَفَةً‌ وَاتَّقُوۡا اللّٰهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ‌ۚ﴾

অর্থ: ‘হে ঈমানদারগণ! এ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া বন্ধ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১৩০)।

وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ

অর্থ: ‘মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে; অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে। (সূরা: আর রূম, আয়াত: ৩৯)।

পবিত্র কোরআনে বহু ধরনের গুনাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সেসবের জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সূদের ক্ষেত্রে যত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোনো গুনাহের ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি। 

এজন্যই সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুদ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রাসূলে করিম (সা.) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ নাজরানের খৃষ্টানদের সঙ্গে তিনি যে সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখে পাঠান- ‘যদি তোমরা সুদী কারবার করো তাহলে তোমাদের সঙ্গে চুক্তি ভেঙ্গে যাবে এবং আমাদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।’ 

বনু মুগীরার সুদী লেনদেন সমগ্র আরবে প্রসিদ্ধ ছিল। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের প্রাপ্য সমুদয় সুদ বাতিল করে দেন এবং মক্কায় তাঁর নিযুক্ত তহসীলদারদেরকে লিখে পাঠান, যদি তারা (বনু মুগীরা) সুদ গ্রহণ করা বন্ধ না করে তাহলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো।

রিবা বা সুদের অবৈধতা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমের ছয়টি আয়াত (সূরা: আল বাকারার ২৭৫-২৭৬, ২৭৮-২৮০; আলে ইমরান ১৩০ এবং রুম ৩৯) এবং চল্লিশটিরও বেশি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিছ তুলে ধরা হলো-

বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন, সুদখোরের ওপর, সুদদাতার ওপর, এর লেখকের ওপর ও ওহার সাক্ষীদ্বয়ের ওপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান… (মুসলিম/জাবির (রা.), আবূ দাউদ, তিরমিযী)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সুদ হলো সত্তর প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো- আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করা…। (ইবনে মাজাহ/আবু হুরাইরা (রা.)।

নিশ্চয়ই যে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কেয়ামতের দিন তার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম…। (বুখারি, মিশকাত)।

হারাম খাদ্য ভক্ষণ করা শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না…।  (মিশকাত)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) বলেছেন, শবে মেরাজ রাতে আমাকে উর্ধ্বলোকে বিচরণ করানোর সময় আমি আমার মাথার উপরে সপ্তম আকাশে বজ্রে প্রচন্ড গর্জনের শব্দ শুনতে পেলাম। চোখ মেলে এমন কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের পেটগুলো বিশাল ঘরের মতো সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা ছিলো অসংখ্য সাপ ও বিচ্ছুতে পরিপূর্ণ। যেগুলো পেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল (আ.) ! এরা কারা? তিনি উত্তরে বললেন, এরা সুদখোরের দল…। (ইবনে মাজাহ ও আহম্মদ)।

হজরত আবদুর রহমান ইবনে মাসউদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত আছে, যখন কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ও সুদ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ পাক সেই জাতিকে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। (আবু ইয়া’লা ও হাকেম)।

সুদ থেকে অর্জিত এক দিরহাম পরিমাণ অর্থ ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৬ বার ব্যভিচার করা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ…। (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)।

হজরত সামুরা বিন জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দু’জন লোক আমার কাছে আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমির দিকে নিয়ে চলছে। যেতে যেতে আমরা রক্তে পরিপূর্ণ এক নহরের পাড়ে দাঁড়ালাম। এ সময় আমরা দু’জন লোককে দেখতে পেলাম, একজন এ নহরের মাঝে দাঁড়ানো, আরেকজন নহরের পাড়ে দাঁড়ানো। কিনারে দাঁড়ানো লোকটির সম্মুখে অনেকগুলো পাথর। নহরের ভেতরে দাঁড়ানোর লোকটি কিনারার দিকে আসতে ইচ্ছা করলে, পাড়ের লোকটি তার মুখে স্বজোরে পাথর নিক্ষেপ করে যে, লোকটি পুনরায় পূর্বেকার জায়গায় পৌঁছে যায়। সে যতবারই পাড়ে আসতে চায় ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। রাসূলে আকরাম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এ লোকটি কে? যার মুখে পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। উত্তরে বলা হলো এ হচ্ছে সুদখোর ব্যক্তি…। (বুখারি)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) তার স্বপ্ন সম্পর্কে এক দীর্ঘ হাদিসের একাংশে বলেন, ‘সুদখোর মৃত্যুর পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আজাব দেয়া হবে। আর তার আজাব হবে, তাকে এমন নদীতে সাঁতার কাটতে হবে, যার পানি হবে রক্তের মতো লাল। সুদের ভিত্তিতে দুনিয়ায় বসে সে সম্পদ সঞ্চয় করেছে আর হারাম সম্পদ সঞ্চয় করার জন্য তাকে আগুনের পাথর খেতে হবে। এটাই হচ্ছে কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত বরযাখী জীবনের শাস্তি এর সঙ্গে থাকবে তার প্রতি আল্লাহর অভিশাপ…। (বূখারি)।

কোনো ব্যক্তির এক দিরহাম পরিমান সুদ উপার্জন করা মুসলমান অবস্থায় তেত্রিশ বার যিনা করা হতেও বেশি গুনাহের কাজ। (তাবরানী)।

সুদের গুনাহ সত্তরটি। তার মধ্যে অপরাধের দিক থেকে সর্বনিম্ন গুনাহটি হলো, আপন মায়ের সঙ্গে যৌনাচারের গুনাহের সমান। আর সবচেয়ে জঘন্য প্রকারের সুদ হলো, সুদের পাওনা আদায়ের জন্য কোনো মুসলমান ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি করা বা তার সম্পদ দখল করা…। (ইবনে মাজাহ, তাবারানী)।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সুদের হাত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

গাজীপুর কথা