ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

সাপে কাটলে সর্বপ্রথম করণীয়

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

সাপে কাটলে সর্বপ্রথম করণীয়

শহরের তুলনায় গ্রাম অঞ্চলে সাপে কাটার ঘটনা বেশি শোনা যায়। বিষাক্ত শাপের দংশনে অনেককেই প্রাণ হারাতেও শোনা যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে অসতর্কতা, অবহেলা এবং অপচিকিৎসা। সাধারণত মে-অক্টোবর মাসে সাপের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি হয়ে থাকে।
এর মূল কারণ হচ্ছে, এ সময় বৃষ্টি হয় ও চারিদিকে প্রচুর পানি থাকে। তাই সাপ শুকনো জায়গার খোঁজে বাসা-বাড়িতে উঠে আসে। সেখানে কোনোভাবে মানুষের সংস্পর্শে এলে সাপ নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে করে দংশন করে।

এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার, ডা. হিমেল ঘোষ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। চলুন জেনে নেয়া যাক এই সম্পর্কে সঠিক তথ্যগুলো-

বিষধর সাপের প্রধানত দু’টি লম্বা, বাঁকানো ও নালিযুক্ত দাঁত থাকে। দাঁত দু’টি উপরের চোয়ালের সঙ্গে যুক্ত এবং মিউকাস পর্দা দ্বারা আবৃত। সাপের কামড়ের সময় দাঁতগুলো সামনের দিকে সামান্য সোজা হয়ে যায় এবং শিকারের দেহে প্রবেশ করে। এ লম্বা দাঁতের পাশাপাশি ছোট দাঁত থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে।

সাপের বিষ মূলত সাপের লালা আর বিষগ্রন্থি হলো বিশেষায়িত লালাগ্রন্থি। এ বিষগ্রন্থিগুলো চোখের পেছনে নিচের দিকে থাকে। গ্রন্থি থেকে নালির মাধ্যমে বিষ দাঁতে সঞ্চারিত হয়। যখন সাপ দংশন করে, তখন ওই লম্বা দাঁতের নালির মাধ্যমে বিষ আক্রান্তের দেহে প্রবেশ করে। তবে সাপে কাটলেই যে বিষক্রিয়া হবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। কারণ বিষধর সাপের চেয়ে নির্বিষ সাপের সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশে প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপের মধ্যে বিষধর সাপ রয়েছে ২২ প্রজাতির। বিষধর সাপ দংশন করলে শরীরে বিষক্রিয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- ক্ষতস্থানে বিষদাঁতের দু’টি দংশনের চিহ্ন, ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্তপাত, ক্ষতস্থান অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠা, প্রচণ্ড ব্যথা, কখনো কখনো সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া, খাবার ও ঢোক গিলতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ট, চোখে ঝাপসা দেখা ও চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসা, ঘুম ঘুম ভাব, হাত-পা অবশ হয়ে আসা ও অচেতন হয়ে পড়া, ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।

এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে নিকটস্থ হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। সাধারণত নির্বিষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত স্থানে সামান্য ব্যথা, ফুলে যাওয়া বা অল্প ক্ষত সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে এসব লক্ষণ থাকলেও ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়, যেকোনো রোগীকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। বিষধর সাপের কামড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর মূল কারণ যথাযথ সচেতনতার অভাব। ওঝা বা বেদের মাধ্যমে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা করানো এবং রোগীকে হাসপাতালে আনতে বিলম্ব করার ফলে বিষাক্ত সাপের দংশনে অকালে অনেক প্রাণই ঝরে যায়।

বেশিরভাগ আক্রান্তই মনে করেন, সর্প দংশনের দরুণ তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সাপে কাটা ব্যক্তিকে তাই প্রথমেই আশ্বস্ত করতে হবে, তার ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ এর বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে। বেশিরভাগ সাপই নির্বিষ, এমনকি বিষধর সাপের পক্ষেও দংশনের সময় সর্বদা কার্যকরভাবে প্রচুর পরিমাণ বিষ ঢেলে দেওয়া সম্ভব হয় না। এজন্য জরুরিভিত্তিতে তাকে সাহস দেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে বিশ্বাস ও সাহস দুটিই ফিরে পাবেন। হাসপাতালে স্থানান্তরের সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাঁটতে না দিয়ে কাঁধে, খাটিয়ায় বা কোনো যানবাহনের সাহায্যে নিয়ে যেতে হবে। সম্ভব হলে সাপটি দেখতে কেমন তা লক্ষ্য করুন। যদি সাপটিকে মেরে ফেলা হয় তবে মৃত সাপটিকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসককে দেখাতে পারেন। সাপের বর্ণনা পরবর্তীকালে চিকিৎসককে চিকিৎসা পরিকল্পনায় সাহায্য করতে পারে।

সাপে কাটলে আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপদ স্থানে বসে থাকুন। দংশিত স্থান কিছুতেই কাটাছেড়া করা উচিত নয়। কেবল ভেজা কাপড় দিয়ে কিংবা জীবাণুনাশক মলম দিয়ে ক্ষতস্থান মুছে দিতে হবে। আক্রান্ত স্থান থেকে মুখের সাহায্যে রক্ত বা বিষ টেনে বের করার চেষ্টা করা বা ক্ষতস্থানে গোবর, শিমের বিচি, আলকাতরা, লালা, ভেষজ ওষুধ বা কোনো প্রকার রাসায়নিক লাগানো উচিত নয়। দংশনকৃত স্থান থেকে উপরের দিকে একটি লম্বা কাঠ এবং গামছা বা কাপড় দিয়ে কেবল একটি বাঁধন এমনভাবে দিতে হবে। যেন তা খুব আঁটসাঁট বা ঢিলে কোনোটাই না হয় এবং একটি আঙুল একটু চেষ্টায় বাঁধনের নিচ দিয়ে যেতে পারে। কারণ খুব বেশি শক্ত করে বাঁধলে আক্রান্ত অঙ্গে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যেহেতু মাংসপেশীর সংকোচনে বিষ দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তাই সাপে কাটার স্থান বেশি নড়াচড়া করা উচিত নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বমি করানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ কিংবা কানের ভেতর বা চোখের ভেতর কিছু ঢেলে দেওয়া থেকেও বিরত থাকা আবশ্যক।

বিষধর সাপের বিষের প্রভাব প্রতিরোধী বিশেষ ওষুধ হলো অ্যান্টিভেনোম। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে এবং কিছু কিছু জেলা সদর হাসপাতালে সাপের বিষের প্রভাব প্রতিরোধী ওষুধ মজুত রয়েছে। এটিই বিষধর সাপে কাটা রোগীর জন্য একমাত্র চিকিৎসা। অ্যান্টিভেনম বা প্রতিবিষ শরীরে সাপের বিষকে ধ্বংস করে দেয়। ঘোড়ার দেহে সাপের বিষ প্রবেশ করার মাধ্যমে ঘোড়ার দেহে অ্যান্টিভেনম তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। তবে সব বিষধর সাপের বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভেনম কার্যকরী নয়, যেমন- সবুজ বোড়া, সামুদ্রিক সাপ ইত্যাদি।

আবার সব আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে অ্যান্টিভেনম কাজ নাও করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অ্যান্টিভেনমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেক্ষেত্রে সময়মত যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই একমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকই সাপের ধরন, কামড়ের ধরন ও উপসর্গ প্রভৃতি দেখে অ্যান্টিভেনমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং রোগীর বা রোগীর অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে রোগীর দেহে প্রয়োগ করবেন। এ ছাড়া বিষক্রিয়ার জন্য রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজনও হতে পারে। মনে রাখবেন, এসব চিকিৎসা শুধু হাসপাতালেই করানো সম্ভব; বেদে বা ওঝা বা অন্য কোথাও নয়।

সর্প দংশন প্রতিরোধের উপায়

> বেশিরভাগ সর্প দংশনের ঘটনা হয়ে থাকে পায়ে। কাজেই সাপ থাকতে পারে এমন জায়গায়, যেমন- ঘাসের মধ্যে কিংবা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর হাঁটার সময় বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। এজন্য পায়ে লম্বা জুতা বা বুট ব্যবহার করা উচিত এবং অন্ধকারে হাঁটার সময় টর্চলাইট, লাঠি ইত্যাদি সঙ্গে রাখতে হবে।

> কখনো সাপ সামনে পড়ে গেলে ধীর-স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। মনে রাখবেন, সাপ প্ররোচনা ছাড়া অনর্থক দংশন করে না।

> বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন। শয়নকক্ষের সঙ্গে খাদ্যসামগ্রী, যেমন- ধান-চাল কিংবা হাঁস-মুরগি, কবুতর ইত্যাদি না রাখাই ভালো।

> ঘুমানোর সময় মেঝেতে না ঘুমিয়ে খাটের ওপর মশারী ব্যবহার করে ঘুমাবেন। রাতের বেলায় মাচায় শোয়ার ব্যাপারেও বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন।

> কোনো গর্তের মাঝে হাত কিংবা পা দেবেন না ও স্তূপিকৃত লাকড়ি অথবা খড় খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করুন।

> মাছ ধরার সময় ‘চাই’ কিংবা ‘জাল’র মধ্যে হাত দেয়ার আগে সাপ আছে কি-না তা দেখে নিন।

গাজীপুর কথা