ঢাকা,  শুক্রবার  ২৬ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

লেখক মুশতাকের স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে অপরাজনীতি

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

লেখক মুশতাকের স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে অপরাজনীতি

লেখক মুশতাক আহমেদ গতকাল কারাগারে মারা গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে। অত্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যু। তাঁকে গত বছরের মে মাসে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আটক করা হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত চলছিল। তাঁকে খুবই সাধারণ বন্দিদের চেয়ে ভালোভাবে রেখে সম্মানের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি, তবে কারাগারে খুব আরাম আয়েশেই ছিলেন তিনি।

এই দেশের লেখক সাহিত্যিকরা খুবই ক্ষীণপ্রাণ। লেখক মুশতাক আহমেদ নিতান্ত অকৃতজ্ঞের মতো জেলখানার পাঁচ-তারা সুবিধা-উপভোগের ঋণ স্বীকার না করেই বসন্তের এই কোকিল-ডাকা, দখিনা-বাতাস-বওয়া সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। এখন নিন্দুকেরা বলবে, তিনি রাষ্ট্রের অবিচারের শিকার। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এই সব ডাঁহা মিথ্যা কথা।

ঠিক একই রকম না হলেও আমার বাবা খন্দকার মজহারুল করিমের গল্পটাও খানিকটা এই রকম। সরকারবিরোধী নিবন্ধ পত্রিকায় ছাপানোর দায়ে ২০০১ সালে খন্দকার মজহারুল করিমকে রাষ্ট্রায়ত্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড থেকে দুই লাইনের এক চিঠিতে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর সেবার আর কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর যাবতীয় পাওনা আটকে দেওয়া হয়। সে আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিল না বলে তাঁকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি (এর জন্যে আমরা পুরো পরিবার আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ)। তবে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আটকে দেয় (বাবার মৃত্যুর পর সে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে, তার নাম এখন ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ)। খন্দকার মজহারুল করিম সরকারের সদাশয়তার কোনোরকম ঋণ স্বীকার না করেই ২০০৩ সালের ২৬শে মার্চ হৃদরোগে মারা যান। তখনও চাপা গলায় কিছু নিন্দুক বুদ্ধিজীবি বলেছিলেন, এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। আর সরকারের সমর্থক গণ্য-মান্য ব্যক্তিরা সরবে বলেছিলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যুই। স্বাভাবিক মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে হবে।

আমি ও আমার পরিবারের সব্বাই গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের কথাই মেনে নিয়েছি। গুলি না, ফাঁসি না, বোমা হামলা না, নিদেনপক্ষে চাপাতির কোপ হলেও মানা যেত। কিন্তু মার খেয়ে, ধমক খেয়ে, চাকরি হারিয়ে, রোজগার হারিয়ে মানসিক চাপে পড়ে যার হৃদরোগে মৃত্যু হয়, তার মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া আর কি?
মুশতাক আহমেদ বা খন্দকার মজহারুল করিম একা নন, এ রকম উদাহরণ বাংলাদেশে আরো আছে। তালিকা লম্বা করে লাভ কি? একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু ফেসবুক নিউজ ফিডের প্রদর্শনকালের সমান।
আসল কথা, বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিক-প্রকাশকদের শরীরচর্চা করতে হবে। এঁদের স্বাস্থ্য খুব খারাপ। দুই সপ্তাহের রিমান্ড সহ্য করতে পারেন না, এক বছর জামিন না পেলে মুষড়ে পড়েন, দুই-তিন বছর আয়-রোজগার বন্ধ থাকলে চাপ নিতে পারেন না। এ রকম করলে হবে? তা হলে তো স্বাভাবিক মৃত্যুর হার বাড়তেই থাকবে।
রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। রাষ্ট্রব্যবস্থা কাউকে নির্যাতন, নিপীড়ন করে না। সরকারবিরোধী লেখালিখি না করলেই পারেন, তা হলেই রাষ্ট্র কাউকে সামান্যতম তকলিফে পড়তে দেবে না। আর যদি সরকারবিরোধী লেখালিখি করার এতই শখ, তা হলে ব্যায়াম করুন। দৌড়ান, সাঁতার কাটুন, কুস্তি করুন। রিমান্ডের আপ্যায়ন, জেলখানার আয়েশ উপভোগ করার মতো করে শরীর তৈরি করুন। ভালো রকমে টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখুন, যাতে বিনা রোজগারে সংসার চালাতে পারেন।
এভাবে খামোকা বেঘোরে স্বাভাবিকভাবে মরে গিয়ে রাষ্ট্রকে বিব্রত করলে একদম ভালো হবে না, এই কথা সকল লেখক-প্রকাশক-কার্টুনিস্টকে বিনীতভাবে জানিয়ে রাখছি।”
লেখক: রফিকুল্লাহ রোমেল

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন