ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

লবণ মরূদ্যানের পথে-প্রান্তরে

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ৪ জুলাই ২০২০

লবণ মরূদ্যানের পথে-প্রান্তরে

হাজার হাজার বছর আগে এই লোনা মরুভূমির পুরোটাই ছিল আরব সাগরের অন্তরে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাগরের পথ ঘুরে যায়, আরো অনেক পরে প্রকৃতির ইচ্ছায় এ ভূমির নিচু স্থান উত্থিত হয় সমুদ্রের লবণের স্তরকে আগলে রেখে। সেই থেকে এ জনপদ লবণ ভূমি। কোনো গাছপালা নেই, নেই কোনো জনবসতি, চারদিকে অসীম সুন্দর লবণের দৃশ্যমান উপস্থিতি। মুঠো ভরে লবণ নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায় লবণ সমুদ্রের দিগন্তে।

দরগার বাইরে সোদরানা গ্রাম। খানিক হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে স্থানীয় রেস্তোরাঁ খুঁজছিলাম। মেঠোপথের একপাশে কয়েকজন গ্রামবাসীকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানকার রেস্তোরাঁ কোথায়?’

একজন উঠে এসে বলল, ‘এ গ্রামে তো কোনো রেস্তোরাঁ নেই, আশপাশের দশ-বিশ গ্রামেও নেই। আপনি আমার বাড়িতে চলুন কিছু খাবেন।’

আমি তো ক্ষুধার্ত নই, এ গ্রামের রেস্তোরাঁ কেমন তা-ই দেখতে চেয়েছিলাম। এমনকি চা পানের দোকানও নেই।

লোকটির নাম হিদায়াত, বয়স হবে পঞ্চাশ বা একটু বেশি, পরনে কাবলি কুর্তা পাজামা, গ্রামের কৃষক, তবে জমি আছে অনেক। লোক রেখে চাষবাস করান। পাশেই দোতলা পাকা দালান তার নিজের বাড়ি। এ গ্রামে অবস্থাসম্পন্ন কৃষক যেমন আছেন তেমনি আছেন দরিদ্র কৃষক যারা অন্যের জমিতে কাজ করে অন্নসংস্থান করেন। হিদায়াত আঙ্কেলের পাশেই বসে ছিলেন মিনাজ, দুজন সমবয়সী। মিনাজের নিজস্ব জমি নেই, অন্যের খেতে কাজ করেন। একটা ব্যাপার দেখে খুব ভালো লাগল—এখানে জোতদার আর সাধারণ কৃষকের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।

এ গ্রামে একটিমাত্র স্কুল আছে, অষ্টম শ্রেণি অবধি পাঠদান করা হয়। এরপর কেউ পড়তে চাইলে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। গ্রামে কোনো হাসপাতাল নেই, খুব কাছের হাসপাতালও পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরেই, রোগবালাই সারাবার জন্য হাজি পির সাহেবই ভরসা। গ্রামটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ তবে গ্রামে মন্দিরও আছে। মোট গৃহস্থের সংখ্যা প্রায় সত্তর।

হিদায়াত আঙ্কেল আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তেতলার ছাদ দেখিয়ে বললেন, এখান থেকে পুরো গ্রাম দেখা যায়। ছবি তোলা হয়ে গেলে নিচে এসো, পরিবারের সাথে আলাপ করিয়ে দেবো। ছাদ থেকে হাজি পির সাহেবের দরগাহ দেখা যায়, আরেক পাশে মসজিদ চোখে পড়ে, আরো চোখে পড়ে বিশাল এক দিঘি। গ্রামবাসীর জলের উৎস। বাড়িগুলো পাকা আর পরিচ্ছন্ন, এই বিরান অঞ্চলে এত শান্ত আর নির্মল গ্রাম আছে তা কল্পনার অতীত।

নিচে নেমে আর হিদায়াত আঙ্কেলকে খুঁজে পেলাম না। ভেতর বাড়ির দাওয়ায় দুজন নারী বসে ছিলেন, সামনে দুটি শিশু খেলছে। একজনের নাম আবিদা, হিদায়াত আঙ্কেলের স্ত্রী। তাদের নাকি সাত সন্তানের বিশাল সংসার। ছেলেপুলেদের বিয়ে দিয়ে নাতিনাতনির মুখ দেখেছেন। আবিদা আন্টির কানে কম করে হলেও সাত আটটা ছিদ্র করা, তাতে শোভা পাচ্ছে হরেক কানের দুল। আমি গুনতে গুনতে খেয়াল করলাম তার ছেলের বউয়ের কানেও একই সংখ্যক গহনা, এখানকার ট্রেডিশন। বাড়িতে বাকি যত লোকজন ছিল এরাও ভিড় করল দাওয়ায় পরদেশিকে দেখার জন্য।

সোদরাণা গ্রাম

আজ বাড়ির মহিলাদের রান্না হতে অবসর। হিদায়াত আঙ্কেলের কয়েকজন বন্ধু বাইরের উঠোনে মনোযোগ দিয়ে রান্নার ইন্তেজাম করছেন। হেঁসেলের দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় তারা মহা আনন্দিত, বিরিয়ানি রান্না হবে। কেউ আবার দূরের গ্রাম থেকে এসেছেন। বেশ জমজমাট অবস্থা। এই উৎসব-আনন্দ পেছনে ফেলে আমি গ্রামের পথে চললাম।

বাচ্চা ছেলেদের পরনে কাবলি কুর্তা সালওয়ার, পায়ে রবারের স্যান্ডেল, ধূলিধূসরিত পায়ে হেঁটে আসছে পাশের গ্রাম থেকে৷ এ গ্রামে দিনে একটা বাস আসে ভুজ শহর থেকে আর ফিরেও যায় দিনে দিনেই। যার দরকার সে চড়ে বসে, তবে সেদিনই ফিরতে হলে সাহায্য নিতে হয় মোটর বাইকের অথবা নিজ পদযুগলের।

কিছুক্ষণ পর দেখি হিদায়াত আঙ্কেল আমাকে খুঁজে পেয়েছেন গ্রামের একমাত্র সরোবরের ধারে। ধরে নিয়ে গেলেন দুপুরের খাবারের জন্য। জেনানা মহলের বাইরে রান্না, বিরাট ভোজের জন্য পরিবারের সবাই বসে রয়েছে। হাজার নিষেধ কে বা শোনে। একদিকে গ্রামবাসী, অন্যদিকে বেচারা আমি। যতই বলি লবণ মরু পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে ততই এরা অবাধ্য।

দুপুরের আয়োজন করা হয়েছিল মাটন বিরিয়ানি। এ একেবারে ভিন্ন স্বাদের বিরিয়ানি। কলকাতা, হায়দারাবাদী বা লক্ষ্ণৌ-এর বিরিয়ানির মতো নয়। দেখতে একদম গাঁদা ফুলের পাপড়ির মতো হলুদ এবং লালের মিশেল। মুখে দিলে মসলার সুগন্ধ একেবারে হৃদয়ে গিয়ে বেঁধে, মসলা একটু বেশি পড়ে এ বিরিয়ানিতে। স্বাদ ভিন্ন তবে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।

দুপুরের খাবার খেয়ে আমাকে নিয়ে ইসমাইল ভাই ছোটাল তার পঙ্খীরাজ সফেদ মরূদ্যানের পানে।সোদরাণা গ্রামকে না চাইলেও পেছনে ফেলে আসতে হয় ভ্রমণার্থীর ধর্ম পালন করার লক্ষ্যে, কারো কারো হৃদয় ভেঙে বিদায় নিতে হয়।

তখনো সূর্য হেলে পড়েনি। এই জায়গাটা ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে খ্যাত। প্রায় দু কিলোমিটার হেঁটে তবেই মূল মরূদ্যানের দেখা মেলে। পথে অবশ্য সবটাই সাদা গোলাপের পাপড়ি ছিটানো অসীম উদ্যান।মূল লবণ মরুভূমির প্রবেশপথের বাইরে বসেছে হরেক পণ্যের পসরা। সবই গুজরাটি রঙিন হস্তশিল্প। লাল বা রঙিন কাপড়ে সুইয়ের সুনিপুণ কারুকাজ। ব্যাগ, জ্যাকেট, স্কার্ট, বিছানার চাদর, ওয়ালম্যাট ইত্যাদি ইত্যাদি। দোকানির নাম লুতফুর, বাড়ি পাশের গ্রামে। এখানকার স্থানীয় মানুষজন বোধহয় একটু বেশি অতিথিপরায়ণ, যার সঙ্গে আলাপ হয় তিনিই বাড়িতে নিয়ে যেতে চান, খাওয়াতে চান। আশপাশের সব গ্রামেই নারীরা ঘরে এসব হস্তশিল্পে দক্ষ, ঘরে বসে চলে সুই-সুতায় নিজস্ব বুনন।

পথ ধরে চলছে উটের বহর। কারো গাড়িতে মালপত্র, বা কারো গাড়িতে যাত্রী৷ আর একটু পরেই সূর্য বিদায় জানাবে। চারদিকে ধূধূ সাদা মরুভূমি। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আর সাধারণ লবণের চেয়ে আকারে বড়ো এই লবণ মরূদ্যানকে বরফের আস্তর ভেবে সহজেই ভুল করা যায়। পরিশোধন না করে অবশ্য এ লবণ খাওয়া যায় না। লবণ চাষের জন্য অল্প কয়েক কিলোমিটার দূরে আছে লবণ খেত। সেখানে সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত করে খাওয়ার লবণ তৈরি করা হয়।

লোনা মরুতে ইতিমধ্যেই বসে গেছে সংগীতশিল্পীদের আসর। সাদা চোরন বা ধুতি, সাদা কুর্তা, রঙিন পাগড়ি পরিহিত সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রশিল্পীরা হাতে তুলে নিয়েছেন ভোরিন্দো, জোড়িয়া পাভা, সুরেন্দো, মোরচাং-এর মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। নৃত্যশিল্পীরাও মাঝে মাঝে ঐতিহ্যবাহী গুজরাটি কারুকাজের রঙিন লেহেঙ্গা চোলি পরে এসে নৃত্য পরিবেশন করে যাচ্ছেন।

সূর্য ডোবার পূর্বমুহূর্তে আকাশের সঙ্গে সাদা জমিটাকেও লাল রং আবির ছড়িয়ে গেল। স্নিগ্ধ, শান্ত ভূমি আর কনকনে ঠান্ডা বাতাসও যে রং ছড়াতে পারে তা লবণ মরুতে না আসলে জানা যেত না।

একেকটা লবণের কণা হেসে উঠেছে লাল রং কাছে পেয়ে। যেকোনো কিছুরই রং প্রয়োজন। রঙিন হতে বা রঙিন করতে জগৎকে। সেইসঙ্গে লোকগীতি এক অনন্য অর্থ নিয়ে বিদায় জানাচ্ছে গত হয়ে যাওয়া দিনকে আর চকচকে রুপোর পাতের মতো চাঁদকে টেনে এনেছে লবণ মরুদ্যানের হৃদয়ের খুব কাছে। ‍সংগৃহীত।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন