ঢাকা,  শনিবার  ২০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

মৌ চাষিদের গ্রামে পরিণত হচ্ছে গাজীপুরের পিরুজালী গ্রাম

প্রকাশিত: ১২:০৫, ১৮ নভেম্বর ২০২০

মৌ চাষিদের গ্রামে পরিণত হচ্ছে গাজীপুরের পিরুজালী গ্রাম

ঘন সবুজ গ্রাম গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী। সারা বছরই লেগে থাকে ফল-ফুলের সমারোহ। জাতীয় ফল কাঁঠাল, আম, লিচু, পেয়ারা, সরিষাসহ নানা ধরনের ফল-ফসলে ভরে থাকে আবাদি জমি। এতো ফুলের কারণে মধু চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গ্রামটি ধীরে ধীরে মৌ চাষিদের গ্রামে পরিণত হতে চলেছে। বিভিন্ন পেশা ছেড়ে মৌমাছি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের উদ্যোক্তারা। 

তিন বছর আগেও একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন পিরুজালী গ্রামের কেফাত উল্লাহ খানের ছেলে সজীব আলম খান। প্রতিদিন ভোরে উঠে কর্মস্থলে যাওয়া, রাত ৯টায় বাড়ি ফিরে আসা ছিল তার রুটিনমাফিক কাজ। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি ছাড়া বাড়ির লোকজনসহ এলাকার বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এবং মুরুব্বিদের সঙ্গে তার দেখা সাক্ষাৎ হতো না বললেই চলে। জীবন চলতো যন্ত্রের মতো।

এক লিচু মৌসুমে দেখতে পান মৌয়ালরা বিভিন্ন এলাকা থেকে মৌমাছির বাক্স নিয়ে এসে ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মধু উৎপাদন করে নিয়ে যায়। তাদের এ কাজ দেখে উৎসাহিত হন সজীব। যান্ত্রিক জীবন থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজলেন তিনি। শুরু করলেন মৌমাছির খামার। নাম রাখলেন ‘সূচনা অ্যান্ড সুচী মৌ খামার’।

সজীব জানান, প্রথম বছর পাঁচটি বাক্স নিয়ে মৌমাছির চাষ শুরু করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে তার বাক্স দাঁড়ায় ৫৫টিতে। বছরে আম, কাঁঠাল ও লিচুর মৌসুমে সবচেয়ে বেশি মধু উৎপাদন হয়। একবার একটি বাক্স তৈরিতে মৌমাছি কেনাসহ খরচ পড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বছরে একটি বাক্স থেকে ৪০ কেজি মধু আহরণ করতে পারেন। ৮০০ টাকা কেজি দরে খামার থেকেই মধু বিক্রি করতে পারেন। মধু আহরণ ও অন্যান্য কাজে প্রতিদিন তিন জন শ্রমিক নিয়োজিত থাকেন। উন্মুক্ত স্থানে বাক্সগুলো নিশ্চিন্তে রাখা যায়। মৌমাছির হুল ফোটানোর কারণে বাক্স চুরি হওয়ার কোনও ভয় থাকে না। মধু আহরণের জন্য বিভিন্ন এলাকায় বাক্স নিয়ে যান। যেসব এলাকায় মৌসুমি ফুল ফলের সমারোহ থাকে ওইসব এলাকায় ২০ দিন বা এক মাসের জন্য বাক্স নিয়ে ভ্রমণ করে মধু সংগ্রহ করেন।

এই উদ্যোক্তা আরও জানান, প্রতিটি বাক্সে চার থেকে পাঁচটি ফ্রেম থাকে। এসব ফ্রেমে মৌমাছি চাক বেঁধে থাকে। আনুমানিক পরিমাণ ভেদে প্রতিটি ফ্রেম মৌমাছির মূল্য ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। পরিমাপ ঠিক ঠাক রেখে বাক্স তৈরির জন্যও প্রশিক্ষিত লোক রয়েছে। সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা খরচে একটি বাক্স তৈরি করা সম্ভব।

সজীব জানান, আগ্রহী হওয়ার পর গাজীপুরের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি মৌমাছির চাষ করেন। তার মৌ চাষ দেখে উৎসাহিত হয়েছেন এলাকার আরও বেশ কয়েকজন যুবক। তাদের মধ্যে একই গ্রামের আবু নাসের খানের ছেলে লোকমান খান জানান, সজীবের মৌমাছি লালন পালন দেখে তিনি উৎসাহিত হয়েছেন। পরে তার কাছ থেকেই ১০টি মৌমাছির বাক্স নিয়ে মৌ চাষ শুরু করেন। তিনিও পরবর্তী সময়ে বাক্স বাড়ানোর কথা ভাবছেন। মৌচাষ একটি স্বাধীন কাজ হওয়ায় তিনি কিছুদিন পর পোশাক কারখানার কাজ ছেড়ে দিয়ে মৌচাষে পুরোপুরি সময় দেওয়ার কথা ভাবছেন বলেও জানান।

সজীবের গ্রামের পার্শ্ববর্তী বর্তাপাড়া এলাকার পারফেক্ট মৌ খামারের মালিক গিয়াস উদ্দিন আকন্দের ১১০টি মৌ বাক্স রয়েছে। তিনি জানান, প্রায় ৯ বছর আগে লিচুর মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌ খামারিরা বাক্স নিয়ে তাদের এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসেন। ওই খামারিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনিও বছর তিনেক আগে প্রথমে শখের বশে মৌমাছির চাষ শুরু করেন। পরে লাভজনক হওয়ায় স্থায়ীভাবে মৌমাছির চাষ করছেন। বর্তমানে তার খামারে সার্বক্ষণিক চার জন লোক কাজ করছেন।

তিনি বলেন, ‘দেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে মধু কিনে নিয়ে যায়। আমাদের প্রধান ক্রেতা তারাই।’
পিরুজালী এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকার প্রায় প্রতিটি দোকানেই ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট পণ্যের পাশাপাশি কিছু কিছু মধু রেখে বিক্রি করেন। প্রায় প্রতিটি দোকান থেকেই মধু বিক্রি হয়।’

একই এলাকার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল খালেক বলেন, ‘একজনের দেখাদেখি আরেকজন, এভাবে বেশ কয়েকজন মৌচাষি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। যারা এ চাষের সঙ্গে যুক্ত তারা সবাই বেশ লাভবান। ফলে এলাকার অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন মৌচাষে।’

গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মাহবুব আলম জানান, ‘মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটাতে সাহায্য করে। ফলে যেসব এলাকায় সরিষার ফলন বা মৌসুমি ফুল-ফলের চাষ বেশি হয়, সেসব এলাকার মৌমাছি চাষের ফলে ফুল-ফসল ১৫-২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। একইভাবে নানা ধরনের বরিশস্যের ফলনও বাড়ে। এছাড়া মধু দেশের চাহিদা পূরণ করে বিভিন্ন দেশে রফতানি করে আসছেন খামারিরা। মধু চাষ করে একদিকে লাভবান হচ্ছেন মৌচাষিরা, অন্যদিকে লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও। মৌচাষ সম্প্রসারণ হলে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতি আর্থিকভাবে লাভবান হবে।’

গাজীপুর কথা