ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

মোগল ঐতিহ্যের স্মারক তিন গম্বুজ শাহী মসজিদ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৪ মে ২০২১

মোগল ঐতিহ্যের স্মারক তিন গম্বুজ শাহী মসজিদ

পাবনা জেলা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চাটমোহর উপজেলা সদর। আর চাটমোহর উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব এক নিদর্শন ঐতিহাসিক চাটমোহর শাহী মসজিদ।

মসজিদ থেকে প্রাপ্ত শিলালিপির তথ্য মতে, ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের শাসনামলে আবুল ফতে মোহাম্মদ মাসুম খাঁর অর্থায়নে তারই ভাই মুহামদ্দ বিন তুর্কি খান কাকশাল চাটমোহরে মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট চাটমোহর শাহী মসজিদের নির্মাণ কৌশলে প্রাচীন সুলতানী স্থাপত্যের প্রভাব রয়েছে।

বগুড়ার খেরুয়া মসজিদের সাথে সাদৃশপূর্ণ ছোট ছোট পাতলা জাফরী ইটের সমন্বয়ে নির্মিত চাটমোহর শাহী মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট, প্রস্থ ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৪৫ ফুট। প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর পূর্বে নির্মিত এই মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় করেন।

jagonews24

স্থানীয় প্রবীণজনরা বলেন, এক সময় চাটমোহর ছিল পাবনার একটি অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। তখনকার সময়ে এখানে মোঘল ও পাঠানদের অবাধ বিচরণ ছিল। তখনই মুহামদ্দ বিন তুর্কি খান কাকশাল মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটিই আজকের চাটমোহর শাহী মসজিদ। তবে অনেক বইয়ের পাতায় এটিকে মাসুম কাবলির মসজিদ বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

এই মসজিদে তুঘরা লিপিতে উৎকীর্ণ একটি ফারসি শিলালিপি ছিল। তবে বর্তমানে শিলালিপিটি রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে। লাল জাফরী ইটে নির্মিত এই মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। জাফরী ইটের ব্যাখ্যায় জানা গেছে, এই ইটগুলো বর্তমান সময়ের ইটের মতো মোটা হত না, ইটগুলো চিকন হয় বলেই জাফরী বলা হয়। মসজিদের দেয়াল প্রায় ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া। মসজিদের ভেতর ৩টি কাতার দাঁড়াতে পারে। এর ভেতরে কালিমা তাইয়েবা লিখিত একটি কালো পাথর রয়েছে। বর্তমানে মসজিদটি একটি সংরক্ষিত ইমারত।

jagonews24

একসময় মসজিদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ৮০’র দশকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর পরিপূর্ণভাবে মসজিদটি নির্মাণ করে। তবে পুনর্নির্মাণের কয়েকবছর পর মসজিদের তিনটি গম্বুজ ও ছাদ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে মসজিদটি সংস্কার ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

চাটমোহর মসজিদ থেকে প্রাপ্ত তুঘরা শিলালিপিটি বর্তমানে রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এ শিলালিপি অনুসারে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে খান মুহম্মদ বিন তুর্কি খান কাকশাল মসজিদটি নির্মাণ করেন। চাটমোহর শাহী মসজিদের দেয়ালে থাকা প্রাচীন ভাস্কর্যগুলো মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক।

চাটমোহরে তিন গম্বুজ সমৃদ্ধ শাহী মসজিদে দেখা যায়, মসজিদটিতে তিনটি দরজা বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের তিনটি দরজার মধ্যে প্রধান প্রবেশপথে উঁচু দরজার ওপরে কালো পাথরের মাঝে খোদাই করা কালেমা শাহাদাৎ লেখা রয়েছে। মূল প্রবেশ পথটি ছাড়া অন্য প্রবেশপথ দুটি একই ধরনের।

মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে মোট তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাব থেকে দুই পাশের মিহরাবে রয়েছে বড় সুড়ঙ্গের মতো অপূর্ব নিদর্শন।

jagonews24

সুলতানি রীতিতে মসজিদটির কার্নিশ সামান্য বাঁকানো। খিলানগুলিতে এখনও গোলাপ নকশার চিহ্ন রয়েছে। প্রতিটি খিলান পথেরই দু’পাশে রয়েছে দুটি করে আয়তাকার খোপ নকশা। নকশাগুলি বর্তমানে ফাঁকা, তবে আগে হয়ত এখানে অলঙ্করণ ছিল।

দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ছাঁচে ঢালা ব্যান্ড নকশার একটি সারি রয়েছে। যে কারণে মসজিদটিকে বাইরে থেকে দেখতে দ্বিতল বলে মনে হয়। মিহরাবগুলি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত এবং শুরুতে এগুলিতে পোড়ামাটির অলঙ্করণ ছিল যার চিহ্ন এখনও খুঁজে পাওয়া যায়। গোলাপ নকশা, পুষ্পলতা এবং জ্যামিতিক নকশার মতো নানা রকম মোটিফ এখানে ব্যবহৃত হয়েছিল।

চাটমোহর শাহী মসজিদের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সাইট পরিচালক শাহজাহান আলী জানান, পাবনার এ মসজিদ এবং বগুড়ার শেরপুরে অবস্থিত খেরুয়া মসজিদ দুটিই ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এবং হুবহু একই পরিকল্পনা বিশিষ্ট। বাংলায় বিদ্যমান মুঘল ইমারতের মধ্যে এ দুটি সর্বপ্রাচীন নিদর্শন। যদিও ইমারত দুটি মুঘল আমলে নির্মিত কিন্তু এগুলির বর্তমান রূপে এ অঞ্চলে প্রচলিত সুলতানি স্থাপত্য রীতির সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বক্র কার্নিশ, দ্বিকেন্দ্রিক সুচাঁলো খিলান, অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব, গম্বুজ, গম্বুজ নির্মাণে বাংলা পেন্ডেনটিভের (লম্বমান অংশ) ব্যবহার প্রভৃতি সবই সুলতানি স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। তবে সুলতানি রীতির এসব বৈশিষ্ট্য থাকলেও অন্ততপক্ষে মসজিদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় এ রীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

jagonews24

তিনি বলেন, বাংলায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ পরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল এখানেই। পরবর্তীকালে এ পরিকল্পনার সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত রূপ দীর্ঘদিন এ অঞ্চলের স্থাপত্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

তিনি আরও জানান, সুলতানী-মোঘল আমলের শাহী মসজিদ দেখতে সারাবছর বহু মানুষ আসেন পাবনার চাটমোহরে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা আসেন তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও এর কারুকাজ দেখতে।

দূর থেকে মসজিদটি বিশাল মনে হলেও ভেতরে মাত্র দুই কাতার লোক নামাজে দাঁড়াতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় এই মসজিদে। ওই মসজিদে একজন ঈমাম ও একজন মোয়াজ্জিন রয়েছেন।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন