ঢাকা,  শনিবার  ২০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

বাংলার ঐতিহ্য : আসবে না ফিরে আর কোনোদিন

প্রকাশিত: ১৪:৫৫, ২৭ এপ্রিল ২০২০

বাংলার ঐতিহ্য : আসবে না ফিরে আর কোনোদিন

বাংলাদেশের অনেক ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম গরুর গাড়ি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল, যা সেখান থেকে এসে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে। গরুর গাড়ি আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্য। গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই গরুর গাড়ি। ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে...এই গান এখন আর গাড়িয়াল ভাইয়েরা গান না। আগে প্রায় সর্বত্রই গরুর গাড়ি ছিল যাতায়াত ও পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যান। লোকজন গরুর গাড়িতে চড়ে আত্মীয়ের বাসায় যাতায়াত করত। অনেকেই গরুর গাড়িতে মাইক বেঁধে গান বাজাতে বাজাতে আন্দ-উল্লাস আর উত্সবমুখর পরিবেশে বিয়ে করতে যেত। এখন আর কেউ গরুর গাড়িতে চড়ে বিয়ে করতে যায় না। ছোটোকালে গ্রামের বাড়িতে দেখেছি, জমির ধান কেটে গরুর গাড়িতে বোঝাই করে আনা হতো। চারদিকে হইহই রইরই ধুম পড়ে যেত। ধানের বোঝা আনার সময় গাড়িয়ালরা গান ধরতেন। গরুর গাড়ি যখন সারিবদ্ধভাবে চলত, তখন এ অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন এ দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। বরং গল্প হয়ে ইতিহাসের পাতার স্থান করে নিয়েছে। ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি।

আমাদের দেশের আরেকটি ঐতিহ্য ঢেঁকি। প্রাচীনকাল থেকে ভারত উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। বহুকাল থেকেই এদেশেও এর প্রচলন রয়েছে। কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহি ঢেঁকি। ঢেঁকি নিয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক অনেক কবিতা গল্প লিখেছেন। ঢেঁকির গুণ সম্পর্কে প্রবাদ বাক্য রচনা করেছেন—ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান ভানে। কিন্তু আজ তা চোখেই পড়ে না। হাতেগোনা কিছু কৃষকদের বাড়িতে ঢেঁকি চোখে পড়লেও তার ব্যবহার নেই। গ্রামের বাড়িতে আগে ঢেঁকিতে মেয়েরা আউশ ধান কুটে চাল বানাত। লাল চাউলের ভাত খেতে ভারি মিষ্টি এবং এটি দূষণমুক্ত। অনেক সময় চাল কুটে আটা বের করত। চাল ও আটা বানানোর সময় মেয়েরা গান গাইতে গাইতে ঢেঁকির পাড় দিত। শীলকালে পিঠা খাওয়ার সময় প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি দ্বারা চাল বানানোর শব্দে পুরো গ্রাম মুখরিত থাকত।

বায়োস্কোপ এদেশের হারিয়ে যাওয়া আরো একটি ঐতিহ্য। একটি ছোটো বাক্সের ছিদ্র দিয়ে ভেতরের স্থির চিত্র দেখানো হতো। বাইরে থেকে বায়োস্কোপওয়ালা হাতে ছোটো ঢোল বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে হাত নেড়ে একটার পর একটা ছবি দেখাত। বাক্সের কাচের জানালার চোখ রাখতেই ছবি আর সুর করে কণ্ঠের বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠত এক অজানা পৃথিবী। বিনোদনের এই মাধ্যমটি আমাদের দেশে বায়োস্কোপ নামে বেশি পরিচিতি পেলেও ইংরেজিতে একে পিপ শো বলে অভিহিত করা হয়, যার অর্থ উঁকি দিয়ে দেখা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্টিফেন্স নামক এক বিদেশি বাংলায় প্রথম বায়োস্কোপ দেখান। ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের হয়ে তিনি প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন। তার অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন এর দুই বছর পর ১৮৯৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বায়োস্কোপ আর দেখা যায় না। দিনবদলের এই যুগে বায়োস্কোপের স্থান হয়েছে জাদুঘরে।

কলের গান ছিল এদেশের আরো একটি ঐতিহ্যের নাম। প্রায় ৮০ বছর ধরে বাঙালির গৃহবিনোদনের প্রধান উপকরণ ছিল কলের গান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কলের গান এখন নেই বললেই চলে। যদিও-বা কোথাও দেখতে পাওয়া যায়। তবে তা শো পিস হিসেবে ড্রয়িংরুমে শোভা বর্ধন করে চলেছে। গ্রামোফোন বাঙালি এককালে যাকে চিনত কলের গান নামে। এর অস্তিত্ব বেশ কয়েক দশক আগেই বিলুপ্ত। মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিশন (১৮৪৭-১৯৩১) শব্দযন্ত্র আবিষ্কার করে এর নাম দেন গ্রামোফোন। জ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির ফলে নতুন প্রযুক্তির কাছে হার মেনে কলের গান বাঙালির জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।

আগে দাড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, গোল্লাছুট, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, এক্কাদোক্কা, ডাংগুলি, চোর-পুলিশ, লুডু, লাটিম, মার্বেল, সাইকেলের টায়ার চালিয়ে খেলেছি। অনেক সময় বাড়ির ছাদে কিংবা মাঠে ঘুড়ি উড়িয়েছি। এগুলি আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। এখন এসব খেলা ক্রমেই বিলীন হতে চলেছে। ছেলেমেয়েরা কম্পিউটারে গেম খেলতে ভালোবাসে। অবসর সময়টুকু ফেসবুকে কাটিয়ে দেয়।

আগে পত্রের মাধ্যমে সবাই চিঠি লিখত। এখন আর কেউ চিঠি লেখে না। ডাকঘর ও ডাকপিয়ন কী, তা এখনকার ছেলেমেয়েরা চেনেই না। বরং বলে, এগুলি কী এবং কে? কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলার লাঠিখেলা, যাত্রাপালা, নাগরদোলা, জাঁতা, চরকি, পালকি, টাপরওয়ালা ছই, বাঁশের তৈরি মাছ ধরার পলো, ডারকি, মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি হস্তশিল্প ইত্যাদি। গ্রামের বিলে পদ্মফুলের সমারোহ এখন আর দেখা যায় না। পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণে এই ফুলটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন এগুলি শুধুই গল্প আর ইতিহাস। এগুলি আসবে না ফিরে আর কোনদিন।

লেখক :সাবেক র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তা

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন