ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কারাগার ‘দেখা’

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৮ আগস্ট ২০২০

ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কারাগার ‘দেখা’

পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন ছিল ২৪ বছরের মতো, ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি সময়, প্রায় ১৩ বছর কেটেছে তাঁর কারাগারে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি ছিলেন   ‘শত্রুরাষ্ট্র’ পাকিস্তানের বন্দি। এ সময়ে তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছিলেন অবরুদ্ধ-গৃহবন্দি। সর্বক্ষণ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রহরা। স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রশ্নই আসে না। বাকি যে এক যুগের মতো বঙ্গবন্ধু প্রধানত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন, তখন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কত বার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমি বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ এবং ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের যে পাঁচটি খণ্ড এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার সাহায্য গ্রহণ করেছি।

‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘জেল কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই তারা বুঝতে পারে না সেটা কি বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে। .... এ সাক্ষাৎকে প্রহসনও বলা চলে।’ [পৃষ্ঠা ১৯৬-৯৭]

একই গ্রন্থের ৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় একজন আইবি কর্মচারী বসে থাকত, আর জেলের পক্ষ থেকেও একজন ডিপুটি জেলার উপস্থিত থাকতেন। .... স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো স্ত্রীকে নিষেধ করে দেই যাতে না আসে। ১৯৪৯ সাল থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম ঢাকায় আসতে, কারণ ও তখন তার দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশের বাড়ি থাকত।’

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। কৈশোরেই তাকে কয়েকদিন কাটাতে হয় চার দেয়ালের মাঝে। পাকিস্তান আমলে প্রথম গ্রেফতার হন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ডাকা হরতালের পিকেটিং করতে গিয়ে। পরের বছর ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করার কারণে। এ সময়ে ১৫ টাকা জরিমানা না দেওয়া ও মুচলেকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কার করা হয়। দুই মাসের বেশি সময়ের এ বন্দি জীবনে চট্টগ্রামের তরুণ মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘আপস কর, ক্ষমা চাও’। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন। [সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৫৬-৫৭]

এ সময়ে গোপালগঞ্জে বসবাস করা বেগম মুজিব স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসেছেন, তেমন বিবরণ গোয়েন্দা রিপোর্ট বা অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে মেলে না। তবে গোয়েন্দা রিপোর্টের প্রথম খণ্ড [পৃষ্ঠা ১৭৬] থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালের ৭ জুন পিতা শেখ লুৎফর রহমান নিরাপত্তা বন্দি পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ১১ জুন একই জেলে পিতা-পুত্রের ফের সাক্ষাৎ ঘটে। ২২ জুন কারাগারে সাক্ষাৎ করেন ছোট বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। ২৬ জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন।

এরপর তিনি গ্রেফতার হন ওই বছরেরই (১৯৪৯) শেষ দিনে। কারাগারে থাকেন দুই বছরের বেশি, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন, স্ত্রীকে ঢাকা কারাগারে সাক্ষাৎ প্রার্থী হতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী ও পিতামাতার মন কি মানে? এই জেল জীবনের এক পর্যায়ে ১৯৫০ সালের শেষ দিকে একটি মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের আদালতে হাজির করার জন্য স্টিমারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, মধুমতি নদীর পাটগাতি স্টিমার ঘাটে নামার পর খবর মেলে, ‘পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওনা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।’ [পৃষ্ঠা ১৭৬]

ত্রিশ বছরের যুবক তখন বঙ্গবন্ধু। স্ত্রীর বয়স ২০ বছর। কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কি?’ [পৃষ্ঠা ৪০]

কী প্রেমময় উপস্থাপনা জাতির জনকের! একইসঙ্গে মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক! সে সময়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে উদীয়মান সূর্য ছিলেন তিনি। একইসঙ্গে ছিলেন পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ এবং ভালবাসার দাবি পূরণে গভীর আন্তরিক। এ ঘটনা দুটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে, যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙ্গার ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে ফাঁসির দড়ি সামনে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। সেই কঠিন সময়ে যেভাবে তিনি নিজের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তা সাহিত্য গুণে অতুলন এবং বিশ্বসেরা পরিচালকের চলচ্চিত্রের অনন্য চিত্রনাট্য হিসেবে গণ্য হতে পারে।

গোপালগঞ্জের আদালতে এ মামলা চলাকালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থানায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাতের সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ রয়েছে ১৮৪ পৃষ্ঠায় এভাবে, ‘‘আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। ... কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধ হয় ভাবত, এ লোকটা কে?’ ১৮৫ পৃষ্ঠায় আরেকবার সাক্ষাতের ঘটনা লিখেছেন এভাবে, হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে আসে এখন। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে। ১৯০-১৯১ পৃষ্ঠাতেও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেগম মুজিবের কয়েকবার সাক্ষাতের বিবরণ। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে যখন একাকী পেল পেল, বলল, ‘‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।’’

বঙ্গমাতা তো এমনই হবেন! মানুষের কল্যাণে যিনি নিবেদিত, তিনি জেলে যাবেন, এটা তো তাঁর কাছেও গর্বের বিষয়। তিনি বাধা দেওয়ার কথা ভাবেন নি, বরং সব সময় উৎসাহ-প্রেরণা দিয়েছেন।

এ জেলজীবনের সময়েই রচিত হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির অমর গাঁথা। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সহকর্মী মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন শুরু করেন ফরিদপুর জেলে। সালাম-বরকতের আত্মদানে বদলে যায় এ ভূখণ্ডের ইতিহাস। মুসলিম লীগ জনমনে ধিকৃত সংগঠন হিসেবে গণ্য হতে থাকে। আওয়ামী লীগ পরিণত হয় জনগণের সংগঠনে। ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্ত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন দলের কাণ্ডারি, প্রাণপুরুষ। মুক্তির পর কয়েকদিন বাড়িতে কাটান। পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা-বেদনার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল।... এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’’ আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘‘আমি তো তোমারও আব্বা।’’

কী জীবন বেছে নিয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা! স্ত্রী-কন্যা-পুত্র অদর্শনে থেকে যায় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। প্রাণ-মন কাঁদে প্রিয়জনের সান্নিধ্যের প্রত্যাশায়। কিন্তু দেশের ডাক ভুলবেন কী করে? তবে এ তো কেবল শুরু, এমন কঠিন জীবন চলেছে আমৃত্যু। কারাগারে থাকার সময় পাকিস্তান সরকার বার বার আপসের প্রস্তাব দিয়েছে, বন্ড দিয়ে মুক্ত জীবন বেছে নিতে বলেছে। কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘জেলে থাক আপত্তি নাই’ অবস্থানে রয়েছেন অটল, দৃঢ়চিত্ত। প্রিয়তম মানুষটি দেশ ও জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে রেখেছেন। তার পাশে সর্বদা থাকতে হবে, সমর্থন ও উৎসাহ দিয়ে যাওয়ার ব্রত তিনি গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরের বছর নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক। গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়াতে থাকেন সংগঠন গড়ে তোলা ও জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সচেতন করার মহান লক্ষ্য সামনে রেখে। ১৯৫৩ সালের ১৪ মে গোয়েন্দারা ‘অসাধারণ দক্ষতায়’ জিপিও থেকে ‘আটক’ করে একটি চিঠি, যাতে ৫ মে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।’ [গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৩]

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের জন্মের পর লেখা এ চিঠিটি কি প্রাপক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে পৌঁছে ছিল? পৌঁছালে চিঠিটা চোখের জলে কতটা সিক্ত হয়েছিল? গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ৫ মে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ ঈশ্বরদীগামী ট্রেনে ওঠেন। ৬ মে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠের জনসভায় ভাষণ দেন। [পৃষ্ঠা ২২৪, তৃতীয় খণ্ড]

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে জেল থেকে বের হওয়ার পর দুই বছর দুই মাস তিনি মুক্ত জীবনে কাটাতে পারেন। মুক্ত জীবন, কিন্তু সময় কাটে জনারণ্যে, রাজনৈতিক সফরে। যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বিপুলভাব জয়ী হওয়ার পর শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, মে মাসের (১৯৫৪) শেষ দিকে করাচি থেকে ঢাকার বাসায় ফিরে ‘দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘‘আর বোধ হয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধ হয় বাড়িতেই চলে যেতে হবে।’’ [পৃষ্ঠা ২৭০]

বঙ্গবন্ধুর স্থান হয় কারাগারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘৫ জুন আতাউর রহমান খান ও বেগম শেখ মুজিবুর রহমান বিচারাধীন বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে এবং সন্তানদের যত্ন নিতে বলেন।’ [চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১-৪২]

গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ২১ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনটি শিশু সন্তান নিয়ে একজন গোয়েন্দার উপস্থিতিতে স্বামীর সঙ্গে ২০ মিনিট কথা বলেন। সাত বছরের শেখ হাসিনা, পাঁচ বছরের শেখ কামাল ও এক বছরের শেখ জামালের জন্য সম্ভবত এটাই ছিল প্রথম ‘কারাগার দেখা’।

কারাগারে পরবর্তী সাক্ষাৎ ঘটে ২০ জুলাই, ১৯৫৪ তারিখ। বঙ্গবন্ধুর মা রত্নগর্ভা সায়েরা খাতুন এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনাসহ তিন সন্তান নিয়ে বেগম মুজিব জেল গেটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ২৫ আগস্ট, ১৪ সেপ্টেম্বর, ৪ অক্টোবর ও ৩১ অক্টোবর দেখা করেন। প্রতিটি ‘দেখা’ ২০ মিনিটের, গোয়েন্দার উপস্থিতিতে। তিন সন্তানসহ বেগম মুজিবের পরের সাক্ষাৎ ছিল ১১ নভেম্বর। ২৯ নভেম্বর বেগম মুজিব ডিআইজি, আইবি. ইবির কাছে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে যে আবেদন করেন, তাতে তিন সন্তানের নাম দেওয়া হয় এভাবে, হাসিনা বেগম ৭ বছর, কামালউদ্দিন আহমদ ৪ বছর, জামালউদ্দিন আহমদ ২ বছর। ২০ মিনিটের এ সাক্ষাৎ ঘটে সে দিনই। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনসহ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন।

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ তারিখ বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। এর পর প্রায় আড়াই বছর তিনি মুক্ত থেকে সংগঠন ও আন্দোলন জোরদার করায় মনোযোগী হন। তবে সর্বক্ষণ ছিলেন গোয়েন্দা নজরদারিতে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন আতাউর রহমান খান। বঙ্গবন্ধুর হাতে আসে শ্রম, দুর্নীতি দমনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ৩১ মে বঙ্গবন্ধু দলের কাজে অধিক সময় প্রদানের প্রবল ইচ্ছা থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য পদে ইস্তফা দেন, যা গ্রহণ করা হয় ২ মাস ৮ দিনের মাথায়, ৮ আগস্ট। সান্ধ্য দৈনিক ‘চাষী’ জানায়, ‘পূর্বনির্ধারিত চীন সফরের কারণে পদত্যাগপত্র গ্রহণে বিলম্ব ঘটে।’

১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ১১ ডিসেম্বর, এ সময়টি বঙ্গবন্ধু মুক্ত জীবনে কাটিয়েছেন। একটানা চার বছর কিছুটা হলেও পরিবারের সান্নিধ্যে থেকেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পাকিস্তানকে ঠেলে দেয় অন্ধকার যুগে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জারি হয় সামরিক শাসন, বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানে দলীয় কাজে। পরদিন তিনি করাচি থেকে ঢাকায় ফেরেন। তাকে গ্রেফতার করা হয় ১২ অক্টোবর। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবন ফের পরিচিত ছকে, স্বামীকে ‘দেখা’র জন্য নাজিমুদ্দিনে রোডের জেলগেটে নিয়মিত হাজির থাকা। এ পর্ব চলে এক বছরের বেশি, ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

গ্রেফতারের ৮ দিন পর ২০ অক্টোবর (১৯৫৮) বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ডেপুটি আইজি. আইবির কাছে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার স্বামীর সঙ্গে জেল গেটে দেখা করার অনুমতি প্রদানের আবেদন করেন। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১]

সামরিক শাসনামলে জেল গেটে দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৩০ অক্টোবর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বরাবরের মতোই বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি। পরের সাক্ষাতের তারিখ ছিল ২০ নভেম্বর। বেগম ফজিলাতুন্নেছা এবং হাসিনা, কামাল ও জামালের সঙ্গে ছিলেন রেহানা। এই প্রথমবারের মতো কারাগার দর্শন ঘটে শিশু রেহানার, আবেদনে বয়স লেখা ২ বছর। শেখ হাসিনার বয়স লেখা ১০ বছর ১১ মাস (আনুমানিক)। পরের সাক্ষাৎ ছিল ২৮ নভেম্বর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বেগম মুজিব তাঁর স্বামীকে সাক্ষাতের সময় বলেন, সিদ্ধেশ্বরী এলাকার কোয়ার্টারে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। এলাকাটি ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। পানির কষ্ট। তিনি দালালদের মাধ্যমে নতুন একটি বাড়ি ভাড়া নিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সকলে বলছে, শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিলে বিপদ হবে। শেখ মুজিব স্ত্রীকে বলেন, উপযুক্ত বাড়ি না পেলে ছেলেমেয়েদের ফাইন্যাল পরীক্ষার পর যেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়ি চলে যায়। এ সময়ে পিস্তলের লাইসেন্স নবায়ন কিংবা সরকারের কাছে হস্তান্তর এবং ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় সরকারের কাছ যে জমি কেনা হয়েছে তার কিস্তির টাকা পরিশোধের বিষয়েও আলোচনা হয়। পরের সাক্ষাতে (৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৮) বেগম মুজিবের সঙ্গী ছিলেন কেবল শেখ জামাল। এ মাসেই আরও দু’বার ১৭ ও ২১ ডিসেম্বর বেগম মুজিব জেল গেটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। ৬ জানুয়ারির (১৯৫৯) সাক্ষাতের সময় সন্তানদের মধ্যে কেবল শেখ কামাল উপস্থিত ছিলেন। এ সময় একজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন, যার সাহায্যে বঙ্গবন্ধু অ্যান্টি করাপশন বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী সম্পত্তির বিবরণ তৈরি করেন।

পরের সাক্ষাতের তারিখ ছিল এভাবে, ১২ জানুয়ারি (চার সন্তানসহ), ২৭ জানুয়ারি (শ্বশুর শেখ লুৎফর রহমান ও ২ সন্তানসহ), ১২ ফেব্রুয়ারি (সন্তানদেরসহ), ২৬ ফব্রুয়ারি ও ১২ মার্চ। শেষের সাক্ষাতে শেখ মুজিবুর রহসান স্ত্রীকে কম খরচে একটি বাসা ভাড়া নেওয়া ও জিপ গাড়িটি বিক্রির পরামর্শ দেন।

পরের সাক্ষাৎ ছিল ২৭ মার্চ, ১১ এপ্রিল, ২৬ এপ্রিল, ১১ মে, ২৬ মে, ৯ জুন, ১৮ জুন, ৩ জুলাই, ৮ জুলাই, ১৮ জুলাই, ১ আগস্ট, ৮ আগস্ট, ১৮ আগস্ট, ২ সেপ্টেম্বর, ১৭ সেপ্টেম্বর, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৪ অক্টোবর, ২৩ অক্টোবর, ২৮ অক্টোবর, ১১ নভেম্বর, ২৫ নভেম্বর ৩ ডিসেম্বর। ২৩ নভেম্বর বেগম মুজিব কারাগারে দেখা করতে গেলে জানান হয়, বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ হওয়ায় সাক্ষাতের জন্য হাজির হতে পারেন নি। এ পর্যায়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ সাক্ষাৎ ঘটে ১৭ ডিসেম্বর। এ দিন বিকেলেই বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ২৪ ডিসেম্বর বিভিন্ন জেলায় সামরিক শাসকদের সতর্কবার্তা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে।

সামরিক শাসনের যাতাকলের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নতুন জীবন শুরু হয়। তিনি সরকারকে ধোকা দিতে আলফা ইন্সুরেন্সে চাকরি নেন, অফিস করেন বর্তমান গুলিস্তান এলাকায়। সুকৌশলে এ স্থানটিকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। তবে মুক্ত জীবনে থাকলেও তাকে একের পর এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানিমূলক মামলা মোকাবেলা করতে হয়। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এটাও জানতেন, মুক্তজীবন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাই একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই চাইছিলেন। এর পরিণতিতেই ১৯৬১ সালের ৮ অক্টোবর উঠে যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে। এটি তখনও অসমাপ্ত, কিন্তু দ্রুতই পরিণত হয়ে যায় বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। ‘৩২ নম্বর’, জনমনগণ অধিনায়কের ঠিকানা, বাঙালির ঠিকানা।

১৯৫৯ সালের শেষ দিকে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বাঙালির নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি দলের ভেতরে নানা পর্যায়ে ও দলের বাইরে কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। প্রশাসন ও আইন শৃক্সখলা বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও কর্মী, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী, অনেকের সঙ্গেই চলে ধারাবাহিক মতবিনিময়। রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, সামরিক শাসনের অবসান ও রাজবন্দিদের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু করতে হবে। সামনে থাকবে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মুক্তির দাবিতে প্রবল ছাত্র আন্দোলন ছিল এরই পরিণতি। এ আন্দোলনের ‘উস্কানিদাতাকে’ চিনতে ফিল্ড মার্শাল খেতাবধারী আইয়ুব খানের অসুবিধে হয়নি। ৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পান ১৮ জুন। এ সময়ে শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার দায়ে ফজলুল হক হলের ভিপি ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়াও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, জেল গেটে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাক্ষাতের দিনেই রংপুর থেকে তার বাবাও এসেছিলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শেখ হাসিনার সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। [পৃষ্ঠা ১৪]

১৯৬২ সালের বন্দি জীবনের আগেও ১৯৬০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এক মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দুই বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের কারণে ২২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন।

১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি নির্ধারিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে ১৯৬৪ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুকে দুই বার গ্রেফতার করা হয়। এ কারাজীবন ছিল স্বল্প স্থায়ী। এ সময়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন, এমন লিখিত বিবরণ পাইনি। তবে নিশ্চিতভাবেই ধরে নিতে পারি যে মামলা পরিচালনা, জামিনের আবেদন ইত্যাদির প্রয়োজনে তিনি থানা হাজত ও কারাগারের গেটে স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সপ্তম খণ্ডে যে বিষয়বস্তুর তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায় ১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগার থেকে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ চেয়ে ডিআইজির কাছে আবেদন করেছেন।

কারাগারে ‘দেখা’, নতুন অধ্যায়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ হাজার ৬৮২ দিনের কারাজীবনের ভয়ঙ্কর অধ্যায় শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান,ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে দুটি মামলায় এক বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আপিল করে তিনি জামিন পেয়ে যান। পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে লাহোরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধী সর্বদলীয় রাজনৈতিক সম্মেলনে বাঙালির প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক ৬-দফা পেশ করার পর শুরু হয় নতুন করে হয়রানি। তিনি জনগণের দরবারে এ কর্মসূচি নিয়ে হাজির হতে থাকেন। জেলা-মহকুমা-থানায় একের পর এক জনসভা, পথসভা ও কর্মী সমাবেশে বক্তব্য দেন। তাকে নিবৃত্ত করার জন্য দায়ের হতে থাকে মামলা। যশোর ও ঢাকায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জামিনলাভ করেন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকা ফেরার পর তাকে ধানমন্ডি বাসা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। দায়ের হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে তাকে, এটাই ছিল সব মহলের শঙ্কা। ১৯৬৯ সালের শুরুতে যে প্রবল ছাত্র-গণ আন্দালন গড়ে ওঠে তার মুখ্য দাবি ছিল এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। তিনি মুক্ত হন এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি। পরদিন রেস কোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষ প্রিয় নেতাকে বরণ নেয় বঙ্গবন্ধু হিসেবে।

প্রায় দুই বছর ৮ মাসের এ জেল জীবনের সময় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ক্যান্টনমেন্টে সন্তানদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে অনেক বার সাক্ষাৎ করেছেন। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়াও সাক্ষাৎ প্রার্থীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। এ সময়ের সাক্ষাতের কিছু বিবরণ মেলে ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে।

কারাগারের রোজনামচা লেখা শুরু হয়েছে ১৯৬৬ সালের ২ জুন থেকে। এরপর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৯ জুন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জমাদার সাহেব এসে বললেন, আপনার ইন্টারভিউ আছে, বেগম সাহেবা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। হঠাৎ এল, ব্যাপার কি! আজকাল তো ১৫ দিনের কমে দেখা করতে দেয় না। ... ছোট ছেলেটা পূর্বের মতোই ‘‘আব্বা’’ ‘‘আব্বা’’ বলে চিৎকার করে উঠল।’

শেখ রাসেলের কারাগার ‘দেখার’ এটাই প্রথম উল্লেখ। পরের ‘দেখা’র বিবরণ রয়েছে ১৫ জুন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে।... এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।... ছোট মেয়েটার শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে থাকি তা দেখবে।... হাচিনার কলেজ বন্ধ, তাই খুলনা যেতে চায়।... জামালের শরীর খারাপ, গলা ফুলে গেছে।’

২৯ জুন লিখেছেন, ‘... আমার স্ত্রী আসে নাই। তার শরীর অসুস্থ কয়েকদিন ধরে। ...ছেলেমেয়েরা ওদের লেখাপড়ার কথা বলল।... বড় ছেলে কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। লজ্জা পায়।... নিশ্চয়ই রেণুর শরীর বেশি খারাপ নতুবা আসত। সামান্য অসুস্থতায় তাকে ঘরে রাখতে পারত না।’

কী কষ্টের জীবনই না গেছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ৬ জুলাই সিকিউরিটি জমাদার এসে বলেন, ‘চলিয়ে, বেগম সাহেবা আয়া।’ ২৬ জুলাই ‘দেখা’ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ রেণু আমার বড় মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব এনেছে... আমার মতামত চায়।’ ৩ আগস্ট লিখেছেন, ‘দেখা’ এসেছে। আমার স্ত্রী ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছে। ৭ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, সে আসে নাই। রাসেল জ্বর নিয়ে এসেছিল। হাসিনার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে।... মেয়েটা এখন বিবাহ করতে রাজী নয়। কারণ আমি জেলে, আর বিএ পাশ করতে চায়।’

১৯৬৭ সালের ১১ জানুয়ারি ঈদের দুদিন আগের ‘দেখা’ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ ই ঈদের জামাত। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নেবে না। ঈদ করবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে।... জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কাটাতে হয় ঠিক কি!’

এই ঈদের পরদিন বেগম মুজিব বিশেষ অনুমতি নিয়ে কারাগারে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এ বছরের ১৭ মার্চ জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের সদস্যদের ‘দেখা’ পেয়ে লিখেছেন, ‘ছোট মেয়েটা আর আড়াই বছরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল।’ ২২ মার্চ কোরবানীর ঈদে বেগম মুজিব কারাগারে অনেক বন্দি যেন খেতে পারে, সে পরিমাণ খাবার পাঠিয়েছিলেন।

পরের সাক্ষাতের বিবরণ রয়েছে ১৪ এপ্রিল। এ দেখা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১৪ দিনে একদিন ‘দেখা’ আইনে আছে, তাই বোধ হয় তিনি (পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান) বন্ধ করেন নাই মেহেরবানি করে। সংসারের অনটন প্রশ্নে বেগম মুজিব স্বামীকে বলেন, ‘যদি বেশি অসুবিধে হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব।’

২৮ এপ্রিলের ‘দেখা’ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সাথে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা।’ একটি মামলায় শাস্তি হওয়ায় এ সুবিধা! কারা আইনে বিনাবিচারে আটক নিরাপত্তা বন্দি হলে সাক্ষাতের সময় গোয়েন্দা উপস্থিত থাকে, কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটে না। তিনি সন্তানদের বলেন, ‘আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে।’

পরের দুটি সাক্ষাৎ ঘটে ১৭ ও ২৭ মে (১৯৬৭)। কারাগারের রোজনামচায় পরের কয়েকটি মাসের সাক্ষাতের বিবরণ নেই। ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশের রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, হাসিনার সঙ্গে বিয়ের পরদিন ১৮ নভেম্বর ‘জেল গেটের কাছেই আমাদের একটি কক্ষে বসানো হয়।... একটু পর শেখ সাহেবকে উক্ত কক্ষে আনা হয়।’

১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের নির্জন সেলে স্থানান্তর করা হয়। মোট ৩৫ জন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী, ১ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘একাকী কামরায় রাত্রদিন থাকা যে কি ভয়াবহ অবস্থা তাহা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।... সূর্যের আলোও গায়ে স্পর্শ করার উপায় নাই। [পৃষ্ঠা ২৬৩]। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘এপ্রিল মাসে (১৯৬৮) বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে আছেন, খবর পাওয়া যায়। ... একদিন সকাল বেলা সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন কর্মকর্তা বাসায় এসে আমাদের জানায় যে, সে দিন বিকেল তিনটায় শাশুড়ি ও তার ছেলেমেয়েদের শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অনুমতি দিয়েছেন।... শাশুড়ি, হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা ও শিশু রাসেলকে যথাসময়ে সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ... দুই সপ্তাহ পর আবার সাক্ষাৎকারের অনুমতি দেওয়া হয়। ওই তালিকায় শেখ সাহেবের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আমাকেও প্রথম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহের সাক্ষাতের অনুমতির তালিকায় কেবল দুই সপ্তাহ পর পর আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হতো।’ [পৃষ্ঠা ৩৩]

আগরতলা মামলা চলেছিল ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ক্যান্টনমেন্টে আট মাসের বেশি বন্দি জীবনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অন্তত ৩০-৩৫ বার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, এটা ধরে নিতে পারি। বিশেষ অনুমতি নিয়েও সাক্ষাতের ঘটনা ঘটেছে।

ড.ওয়াজেদ মিয়ার গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৬৯ সালের শুরুতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার প্রস্তুতি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ-নির্দেশনা সংগ্রহ করায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা ও ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া সাক্ষাৎকারের সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। সদ্য বিবাহিত শেখ হাসিনা এ সময়ে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোনো পদে নেই, কিন্তু জনপ্রিয় এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নিয়মিত নির্দেশনা পেতে থাকেন তাঁর মাধ্যমে। তিনি এমনকি সুকৌশলে চিঠিও আদান-প্রদান করেন। খবর সংগ্রহের জন্য যে সব সাংবাদিক নিয়মিত ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত থাকতেন, তাদের মাধ্যমেও পরামর্শ আসত। আইনজীবীরাও যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন। ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি ক্যান্টনমেন্টে ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমদ ও ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফকে নিয়ে একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন।

আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দেওয়া হয় প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে অংশ নিতে। কিন্তু তিনি অসম্মত হন। ড. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘১৭ ফেব্রুয়ারি শাশুড়ি, রেহানা, হাসিনা ও শেখ সাহেবের ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকা কাকাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ট্রাইব্যুনাল কোর্ট অফিসের নিকটে পৌঁছাই। ইতিপূর্বে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতাও সেখানে সমবেত হয়েছিলো। এর একটু পর শেখ সাহেবকে আটক রাখা সামরিক মেস হতে বেরিয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী পক্ষের প্রধান কৌঁসুলীর অন্যতম সহকারী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম গাড়ীর পাশ দিয়ে কোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। ... তিনি বলেন যে, শেখ সাহেব তাকে কোর্টে প্যারোল চেয়ে আবেদন পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথা শুনে শাশুড়ি মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। যাহোক, কিছু ক্ষণ পর কয়েকটি সামরিক গাড়িতে শেখ সাহেবসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের কোর্টে আনা হয়। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কোর্টের বাইরে এসে আমাদের অবহিত করেন, শেখ সাহেব আদালতে বলেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্তে প্রত্যাহার করে সকলকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যাবেন না।... এ সংবাদ জানার পর শাশুড়ি কিছুটা আশ্বস্তবোধ করেন।’ [পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯]

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় ক্যান্টনমেন্টের মেসে বঙ্গবন্ধুর রুমমেট ছিলেন মেজর শামসুল আলম। এ নিবন্ধের লেখকের (অজয় দাশগুপ্ত) সঙ্গে একান্তসাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চালু রেখেই মুজিব ভাইকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরের গোলটেবিল বৈঠকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব ছিল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন এই প্রস্তাব নিয়ে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা সালাম খানও এটা চাইছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছেন, বেগম সাহেবা (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) চিঠি দিয়েছেন, তুমি প্যারোলে লাহোর গেলে তোমার বিরুদ্ধে আমি রাস্তায় নামব। তোমার সঙ্গে বন্দি যারা তাদের ছেড়ে যেতে পারবা না। তুমি বলবে, ফ্রিম্যান হিসেবে গোলটেবিলে যেতে চাই। সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।   

এই তো আমাদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। পরিবার ছিল তাঁর কাছে সবার ওপরে। তবে কেবল ঘরের কয়েকজনকে নিয়ে নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণ নিয়েই ছিল তাঁর পরিবার। এই পরিবারের স্বার্থে তিনি যে কোনো ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। সংকল্পে ছিলেন অটল।

বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। পরের দু’বছর তিনি জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন আমাদের এ ভূখণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক কণ্ঠ, জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার জন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্পণ করে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি সামরিক জান্তাকে চ্যালেঞ্জ করে বিকল্প প্রশাসন পরিচালনা করেন। ৭ মার্চ রেস কোর্স ময়দানে অবিনাশী উচ্চারণ করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। একইসঙ্গে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর প্রতি চরম হুশিয়ারি, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারব না।’ এই মহতী অভিযাত্রায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতির পিতা হিসেবে নন্দিত হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য প্রেরণা হয়ে থাকেন। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি ধীরস্থির, বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সংকল্পবদ্ধ। ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। তাকে পাকিস্তানে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বরণ করে নিতে হয় কঠোর সামরিক প্রহরায় গৃহবন্দির দুঃসহজীবন। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও তিনি মুষড়ে পড়েন না, শত্রুর কাছে নতিস্বীকার করেন না। জনগণের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকার কর্তব্য ভোলেন না। তিনি দুই পুত্র শেখ কামাল ও  শেখ জামালকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেন। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর নবজাত সন্তান জয় এবং নিজের অপর দুই সন্তান শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলকে পরম মমতায় আগলে রাখেন। প্রিয়তম স্বামী শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগারে। আগের ১২ বছরের জেলজীবনে নিয়মিত তিনি ‘দেখা’ করতেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে বন্দি রাখা হয় পরিবার ও স্বজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। এই কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুর দিনগুলো কীভাবে কেটেছে, সে অধ্যায় অজানা। তিনি ডায়েরি লিখেছেন, এমনটিই জানা যায়। 

পাকিস্তান সরকার কি তা বাংলাদেশের জনগণের হাতে তুলে দেবে? বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দিনগুলোই বা কেমন কেটেছে? এ সময়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। পিতার জন্য তাদের চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ও পোড়ামাটির নীতির কারণে প্রতিদিন ঝরে যাওয়া নারী-পুরুষ-শিশুদের জন্য অনিঃশেষ যন্ত্রণা ও কষ্টে তারা দগ্ধ হচ্ছেন। রণাঙ্গনে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে অসম সাহসে লড়ছিল দুই ভাই, শেখ কামাল ও শেখ জামাল। তারা কেমন আছে? শত্রুর মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া দুই তরুণের অসম সাহসে লড়ে যাওয়ার চিত্র যদি ধারণ করা থাকত? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত এক সন্তানকে দেখতে চেয়েছিলেন মা। তাকে ট্রেঞ্চের কাছে নেওয়া হলে তিনি মেসিনগান হাতে পুত্রকে লড়তে দেখে বলে ওঠেন, বাহাদুর বেটা, এটাই দেখতে এসেছিলাম। বেগম মুজিবের পক্ষে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে পুত্রদের বীরত্ব দেখার জন্য রণাঙ্গনে ছুটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার মনোজগতে এ চিত্র যে স্থির হয়ে ধরা পড়ে ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। চোখের সামনে বাস্তবে রূপ নিচ্ছিল বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র, এটাও দেখছিলেন।।

সেই স্বপ্ন ও সাহসের দিনগুলোর কথা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কাছ থেকে আরও বিশদভাবে জানার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে রাখছি।

মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক

গাজীপুর কথা