ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

দেশের প্রথম রফতানিমুখী জুতার প্রতিষ্ঠান এপেক্স

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ১৬ মার্চ ২০২১

দেশের প্রথম রফতানিমুখী জুতার প্রতিষ্ঠান এপেক্স

ফুটওয়্যারের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ প্রবেশ করে নব্বই দশকের শুরুতে। এর প্রথম অনুপ্রেরণা মেলে ১৯৮৯ সালে। সে সময় চামড়া প্রদর্শনী হতো হংকংয়ে। এতে অংশ নেয় এপেক্স ট্যানারি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। হংকং-জাপান যোগাযোগ সুবিধার কারণে প্রদর্শনীতে অনেক জাপানি ক্রেতা আসতেন। তাদের মধ্যে এপেক্সের চামড়ার বড় ক্রেতারাও ছিলেন। এপেক্সের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে ‘মারুটোমি’ নামের এক জাপানি জুতা বিক্রেতা কোম্পানির সংযোগ ঘটিয়ে দিলেন তারা। প্রতিষ্ঠানটির তখন শুধু খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রই ছিল প্রায় ১ হাজার ১০০টি।

ওই সময় ভারত বা অন্যান্য উৎস থেকে জুতা কিনতে শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। অন্যদিকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে শুল্কমুক্তভাবে পণ্য আমদানির সুযোগ ছিল ক্রেতাদের। এ কারণে এপেক্সের জাপানি ক্রেতারা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে পরামর্শ দিলেন দেশেই জুতা কারখানা গড়ে তোলার। অন্যদিকে মারুটোমিও এ শুল্ক সুবিধার সুযোগ নিতে বাংলাদেশ থেকে জুতা কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

তখন পর্যন্ত দেশে স্থানীয় উদ্যোগে জুতা উৎপাদন হয়েছে অনেকটা কুটির শিল্পের মতো করে। এক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশের বাজারের চাহিদা পূরণ। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির উপযোগী জুতার কারখানা তখনো একটিও গড়ে ওঠেনি।

রফতানিমুখী জুতা উৎপাদনকারী কারখানা হিসেবে এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের যাত্রা ১৯৯০ সালে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। সে সময় লোকসানি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন ট্যানারিকে নিলামে তোলে সরকার। ১২ লাখ ২২ হাজার ডলারে ট্যানারিটি কিনে নেন উদ্যোক্তা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় এপেক্স ট্যানারি।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর হাতে পড়ে চামড়াজাত জুতার ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি। ফলে জুতার রফতানিমুখী প্রথম কারখানা হিসেবে যাত্রা করলেও ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি এপেক্স ফুটওয়্যারকে।

চামড়া রফতানির সূত্র ধরে ইতালীয় ক্রেতাদের সঙ্গে প্রথম সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এপেক্স ট্যানারির। প্রকৃতপক্ষে ইতালীয়রাই ছিল ট্যানারিটির প্রক্রিয়াজাত চামড়ার প্রথম ক্রেতা। কিন্তু বাংলাদেশের পাদুকা শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে তাদের বেশ উন্নাসিক মনোভাব ছিল। পরে ক্রাস্ট লেদার বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানির সুবাদে এপেক্সের সঙ্গে জাপানিদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে চামড়ার মূল্য সংযোজনের সম্ভাবনা নিয়ে জাপানিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক।

ওই ক্রেতারা এক পর্যায়ে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে প্রশ্ন করে বসেন—সারা জীবন শুধু চামড়া রফতানি করবেন? মূল্য সংযোজন করতে হবে না? ক্রেতাদের এ কথা মনে দাগ কাটল সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর।

এ বিষয়ে এপেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ১৯৮৯ সালের কথা বলছি, যখন জুতার একটিও রফতানিমুখী কারখানা ছিল না। প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানিতে আমরা ছিলাম পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান। রফতানিমুখী ফুটওয়্যারেও পথিকৃৎ হওয়ার সুযোগ এলে সেটাও গ্রহণ করলাম। সফিপুরে কারখানা গড়ে তোলা হলো। কিন্তু উৎপাদন, বিপণন সবদিক বিবেচনায় দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন দেখা দিল, যা বাংলাদেশের ছিল না। এ বিষয়ে জাপানিরা সহযোগিতা দিয়ে বলল, তারাই উৎপাদিত জুতা কিনবে। ফলে বিপণন জটিলতাও রইল না। এরপর কারখানা কার্যক্রম শুরু হলো। প্রথমে উৎপাদন সক্ষমতা ছিল দৈনিক ১ হাজার জোড়া। সে সময় পাঁচ-ছয়জন জাপানি বাংলাদেশে এসে বসবাস শুরু করলেন। পণ্যের মান নিয়ে জাপানিদের খুঁতখুঁতে মনোভাব আমাদের কারখানার উৎপাদন মানকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গেল। জাপানে রফতানির মাধ্যমে রফতানিমুখী প্রথম কারখানা হিসেবে যাত্রা করল এপেক্স ফুটওয়্যার।

নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে যাত্রা করলেও পশ্চিমা বাজারে বাংলাদেশের জুতা সরবরাহ হয় ১৯৯৫ সালের দিকে। জাপানে রফতানি শুরুর পর প্রায় আড়াই বছর বেশ ভালো ব্যবসা করে এপেক্স ফুটওয়্যার। কিন্তু প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৯৩-৯৪ সালে। ওই সময় জাপানের অর্থনীতিতে ধস নামল। এপেক্স ফুটওয়্যারের একমাত্র ক্রেতা কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল ১ হাজার ১০০ বিক্রয়কেন্দ্র। বিষয়টি এপেক্সের জন্য দেখা দিল মহাবিপদ হয়ে। কোনো ক্রয়াদেশ ছিল না। তবে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার সুযোগও চলে এল। ওই সময় পূর্বপরিচয়ের সুবাদে জাপানে রফতানীকৃত জুতার নমুনা নিয়ে ইউরোপে গেল এপেক্স।

তবে ইতালিতে বাজার স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়াল নকশার ভিন্নতা। ইতালি ও জাপানে পরিধেয় জুতার নকশা যেমন ভিন্ন, তেমনি ব্যবহারের দিক থেকেও ছিল চর্চাগত ভিন্নতা। জাপানে বাসাবাড়ি, রেস্টুরেন্টসহ অনেক ক্ষেত্রেই জুতা না পরার চর্চা রয়েছে। জাপানে এজন্য ফিতাসহ জুতার ব্যবহার হয় কম। এ কারণে ইতালির ক্রেতারা প্রথম কাজ দিতে চাইলেন না। পরে নমুনা তৈরির আহ্বানে সাড়া পাওয়া গেল। কিন্তু একাধিকবার নমুনা তৈরি করেও আকৃষ্ট করা গেল না ক্রেতাকে।

নব্বই দশকের শুরুতেই এপেক্সের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সন্তান নাসিম মঞ্জুর তার শিক্ষাজীবন শেষ করে ব্যবসায় যোগ দেন। তার উৎসাহে এপেক্স ফুটওয়্যার নিয়ে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচনের সাহস করলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ওই সময় ইতালির একটি জুতা প্রদর্শনীতে অংশ নেয় এপেক্স। পরিচয় হয় ইতালির বৃহৎ জুতা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অ্যাডেলকির সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটি ইতালিতে দৈনিক ৫০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন করত। কর্মী ছিল ১২ হাজার। কিন্তু কোম্পানিটি ইতালিতে জুতা উৎপাদন করে পোষাতে পারছিল না। এপেক্সের সঙ্গে ব্যবসার আলোচনায় আগ্রহ দেখালেন অ্যাডেলকির মালিক। কিন্তু বাংলাদেশের নাম শুনেই পিছপা হলো অ্যাডেলকি। বলল চীনে কারখানা সরিয়ে নেবে।

এ বিষয়ে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, আমি পীড়াপীড়ি করে অ্যাডেলকির মালিককে বাংলাদেশে কারখানা দেখাতে নিয়ে এলাম। তখন তিনি চীনে কারখানা দেখে এসে হতাশ হয়ে ফেরার পথে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি এপেক্সের কারখানা পছন্দ করলেন। কিন্তু প্রথম নমুনা ক্রয়াদেশ দিলেন ৫০০ জোড়ার। এ সময় দক্ষ কারিগরি লোকবল প্রয়োজন হলো। অ্যাডেলকি সে লোকবল দিল। অ্যাডেলকির কাছেই মানসম্পন্ন রফতানিমুখী কারখানা প্রতিষ্ঠার অনেক খুঁটিনাটি শিখলাম। দৈনিক এক হাজার জোড়া থেকে এখনকার ১২ হাজার জোড়ায় যাওয়ার পথে সেই যাত্রা হলো। আমাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল প্রায় ১৬ হাজার জোড়া। এখন রফতানির মূল বাজার ইউরোপ। মোট রফতানির ৩০-৩৫ শতাংশই হয় জার্মানিতে।

এপেক্স ফুটওয়্যারের এখনকার কর্মীসংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। কালে কালে কোম্পানিটির মতো এপেক্স গ্রুপেরও কলেবর বেড়েছে। এ গ্রুপের আওতাধীন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এপেক্স ফার্মা, ব্লু ওশান ফুটওয়্যার, এপেক্স এন্টারপ্রাইজ, এপেক্স ইনভেস্টমেন্ট, গ্রে অ্যাডভারটাইজিং ইত্যাদি।

এপেক্সের পর আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফুটওয়্যার রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে এগিয়ে নেয়। এর মধ্যে বে ফুটওয়্যার, এফবি ফুটওয়্যার, এবিসি ফুটওয়্যার ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত অবদান বাংলাদেশকে ফুটওয়্যার রফতানির শীর্ষ দশের তালিকায় নিয়ে এসেছে। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে দুই ধরনের জুতা বিশ্ববাজারে রফতানি হয়—চামড়াজাত ও চামড়াবহির্ভূত। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ফুটওয়্যার রফতানি হয়েছে ৭৬ কোটি ডলারের। এর মধ্যে শুধু চামড়াজাত জুতাই রফতানি হয়েছে প্রায় ৪৮ কোটি ডলারের। নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য, অচিরেই বাংলাদেশ থেকে বার্ষিক ফুটওয়্যার রফতানি ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।

অথচ এক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে শুধু চামড়া রফতানি হতো। চামড়ার মূল্য সংযোজিত বা প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজারে কোনো অবস্থানই ছিল না বাংলাদেশের। মূলত ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণই এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন