ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

দুনিয়ার সেরা মামলাবাজ ব্যক্তি জোনাথন লি রিচেস

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৯ এপ্রিল ২০২১

দুনিয়ার সেরা মামলাবাজ ব্যক্তি জোনাথন লি রিচেস

নতুন মিলেনিয়ান তখন শুরু হয়েছিল সবে। বিশ্ববাসী তখন ইন্টারনেটে আজকের মত পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেই সময়েই ইন্টারনেটকে চৌর্যবৃত্তির সেরা হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন, ইন্টারনেট ও কম্পিউটারে তুখোড় হয়ে ওঠা ২৪ বছরের আমেরিকান তরুণ জোনাথন লি রিচেস। বাবা বাবা মায়ের সঙ্গে জোনাথন থাকতেন পেনসিলভেনিয়ায়। জোনাথন তৈরি করে ফেলেছিলেন তথ্য হ্যাক করার অসাধারণ এক কৌশল। তখন ইন্টারনেটের ওপর আজকের মত কড়া নজরদারি ছিল না। ফলে সদ্য ইন্টারনেটে আসা মানুষরা জোনাথনের সহজ শিকারে পরিণত হতেন। ধীরে ধীরে জোনাথন গড়ে তুলেছিলেন একটি কুখ্যাত হ্যাকার গ্যাং। যে হ্যাকার গ্যাংটির সদস্যেরা কেউ কাউকে চিনতেন না। একটি গোপন চ্যাট বক্সে নতুন শিকার নিয়ে প্ল্যানিং করে অপারেশনে নামতেন সদস্যরা।

জোনাথন লি রিচেস কোনও মানুষের থেকে হাতিয়ে নেওয়া সমস্ত তথ্য জোনাথন বেচে দিতেন ইন্টারনেট ও ইন্টারনেটের বাইরে থাকা অসাধু ক্রেতাদের কাছে। এছাড়াও সংগৃহীত তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে, শিকারদের আসল অ্যাকাউন্টের টাকা নিয়ে নিতেন শিকারের নামে খোলা ভুয়ো অ্যাকাউন্টে। এইভাবেই জোনাথনের গ্যাং প্রায় দু’হাজার মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল প্রায় পনেরো লক্ষ ডলার। মাত্র এক বছরের মধ্যে।

সেই জোনাথন লি রিচেস, ধরা পড়ে গেলেন ২০০৩ সালে। তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল প্রতারণা, ষড়যন্ত্র, কম্পিউটার হ্যাকিং ও অর্থপাচারের মামলা। বিচারে ১২৫ মাসের জেল হয়েছিল জোনাথনের। সাউথ ক্যারোলিনার কারাগারে তাঁর কয়েদি নাম্বার ছিল #40948-018। ২০০৪ সালে কারাগারে যাওয়া পর, জোনাথন হঠাত্‍ আইন নিয়ে উত্‍সাহী হয়ে উঠেছিলেন। কারাগারের পাঠাগারে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পড়তেন কারাগার ও আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন বই। বোঝার চেষ্টা করতেন নিজের মামলার খুঁটিনাটিও।

২০০৬ সালের মার্চ মাসে, আদালতের কাছে জোনাথন একটি আবেদন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁকে গ্রেফতার করার সময় তাঁর ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্র ফেরত দিতে হবে। বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্রের তালিকায় ছিল ২৩ টি নতুন প্লে-স্টেশন ভিডিও গেম, বিশ্বকাপ কমিটি থেকে পাওয়া একটি স্মারক ফুটবল, ৬৬ টি নতুন শার্ট, একটি মিউজিক সিস্টেম ও কিছু লাইফ জ্যাকেট। জোনাথনের আবেদনকে আমল দেয়নি আদালত। বাজেয়াপ্ত জিনিসপত্রগুলি কোনও সমাজসেবী সংস্থা্র হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারক। অত্যন্ত প্রিয় বস্তুগুলি খোয়ানোর ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন জোনাথন। একটি ন’পাতার অভিযোগ এনেছিলেন কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তাঁরা নাকি ষড়যন্ত্র করে জেলবন্দি করেছিলেন জোনাথনকে। ৩৭৯,১১১,৩৩৯,০০০,০০০ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপুরণের মামলা দাখিল করেছিলেন ৭৮৩ জনের বিরুদ্ধে

জেল থেকে আদালতের পথে উকিল, জজ, পুলিশ, জেলার থেকে বিশ্বের নাম করা ব্যক্তিত্ব, সবাই ছিলেন জোনাথনের তালিকায়। নামগুলি নিজের হাতে লিখতেই জোনাথনের লেগেছিল ৫৭টি পাতা। তালিকার প্রথম নামটি ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (জুনিয়র)। এছাড়াও দাখিল করা মামলাটিতে, জোনাথন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিলেন পোপ বেনেডিক্ট (XVI), বিল গেটস, কোফি আন্নানের বিরুদ্ধেও। শুরু হয়েছিল আইন ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে, জোনাথনের মামলা করার অভিযান। কিন্তু আদালতে মামলা করতে গেলে, মামলা দায়ের করার জন্য ২৫০ ডলার লাগত। ধুরন্ধর জোনাথন আইনের বই ঘেঁটে নিজেই আবিষ্কার করেছিলেন প্রাচীন একটি আইন। যেটি হল 28 U.S. Code § 1915(g)। যে আইনের মাধ্যমে গরিব আমেরিকানদের বিনা পয়সায় মামলা লড়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। জোনাথন আদালতকে জানিয়েছিলেন, তিনি সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত এক আসামি। মাস গেলে কারাগারে তাঁর খাতায় জমা পড়ে মাত্র ১২ সেন্ট। তাই তিনি মামলা দায়ের করার পয়সা দিতে পারবেন না। জোনাথন নিজেই নিজের দায়ের করা মামলার উকিল হয়ে, জেলের ভেতর থেকে ই-মেলের মাধ্যমে মামলা লড়বেন। সুচতুর জোনাথনের নিঁখুত চালে, নিজেরই তৈরি করা আইনের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল আইন ব্যবস্থা। জোনাথন পেয়েছিলেন মামলা করা ও লড়ার অনুমতি। কেউ তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তিরিশ বছরের জোনাথন প্রায় একশ বছরের পুরোনো একটি আইনকে হাতিয়ার করে সমগ্র আইন ব্যবস্থাকে টলিয়ে দেবেন। হাসির খোরাক করে ছাড়বেন।

২০০৮ সালের ৯ এপ্রিল, জোনাথন একটি মামলা দায়ের করেছিলেন, গ্র্যান্ড থেফট ভিডিও গেমের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে। ভিডিও গেমটির বিক্রি বন্ধ করার জন্য সওয়াল করেছিলেন। মামলার সওয়ালের সময় জোনাথন বলেছিলেন, ভিডিও গেমের নির্মাতাদের জন্যই তিনি আজ কারাগারে। কারণ সেই ভিডিও গেমটির মাধ্যমে ভিডিও গেমের নির্মাতারাই তাঁকে শিখিয়েছেন কীভাবে তথ্য চুরি ও পাচার করতে হয়। এছাড়াও ভিডিও গেমটি সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ সেটি সমাজে সেক্স, ড্রাগ ও হিংসা ছড়িয়ে চলেছে। জোনাথনের করা মামলার জন্য ভিডিও গেমটির নির্মাতারা ভিডিও গেমটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ফ্লরিডার আদালতে একটি মামলা চলছিল। জ্যাক্সনভিল ইলেক্ট্রিক অথরিটির সঙ্গে বারনাথ কর্পোরেশনের মামলা। পরিবেশ দূষণ নিয়ে চলা এই মামলায়, ২০০৮ সালে হঠাত্‍ ঢুকে পড়েছিলেন জোনাথন। নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য জোনাথন নতুন করে মামলা করেছিলেন দুটি কোম্পানির বিরুদ্ধেই। ২০ বছর ধরে ঝিমিয়ে থাকা মামলা প্রাণ ফিরে এসেছিল। বিচারক ২২ মিলিয়ন ডলার ফাইন করেছিলেন দোষী সংস্থাটিকে।

মামলা করেছিলেন পারভেজ মুশারফের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের মে মাসে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন জোনাথন। তাঁকে না জানিয়ে বিশ্বরেকর্ডধারী মামলাবাজ আখ্যা দিয়ে রেকর্ডবুকে নাম তোলার জন্য। এরপর জোনাথন একের পর এক মামলা করেছিলেন অ্যাপেলের স্টিভ জোভস, মাইক্রোসফটের বিল গেটস, উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, পপ স্টার ব্রিটনি স্পিয়ার্স, এমনকি বেনজির ভুট্টো ও পারভেজ মুসারফের বিরুদ্ধেও। মামলা করেছিলেন নিজের দেশের ইমিগ্রেশন দফতরের বিরুদ্ধে। তাঁকে পাকিস্তানে নির্বাসনে যেতে না দেওয়ার জন্য।

জোনাথন মামলা করেছিলেন হিটলারের ন্যাশন্যাল সোস্যালিস্ট পার্টি, দার্শনিক প্লুটো, নস্ট্রাডামুস, চে গেভারা, বিভিন্ন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, আইফেল টাওয়ার, আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজ ইউএস এস কোল, বামন গ্রহ প্লুটো, নর্ডিক দেবতা, রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। এমনকি তিনি মামলা করেছিলেন The Holy Grail নামে একটি কাপের বিরুদ্ধে। যে কাপে লাস্ট সাপারের সময় খেয়েছিলেন প্রভু যিশু। ক্রুস বিদ্ধ অবস্থায় থাকা প্রভু যিশুর রক্ত যে কাপে সংগ্রহ করেছিলেন জোসেফ অফ আরিমাথিয়া। মামলাগুলি করার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই কারাগার থেকে প্যারোলে বের হবার ফিকির খুঁজতেন জোনাথন। কখনও তাঁর আবেদনে বলতেন গরীবদের জন্য রক্তদান করতে যাব। কখনও বলতেন হাসপাতালে অসুস্থ শিশুদের দেখতে যাব। কখনও বলতেন পৃথিবীকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে গাছ লাগাব নিজের এলাকায়। কিন্তু জোনাথনের সে সব আবেদন পত্রপাঠ নামঞ্জুর হজোনাথনের নিজের হাতে লেখা একটি মামলার চিঠি কারাগারে থাকা অবস্থায় জোনাথন প্রায় ২৬০০ টি মামলা করেছিলেন। বিচারব্যবস্থাকে জেরবার করে দিয়েছিলেন জোনাথন। তাঁকে আটকাবার জন্য আইন খুঁজছিল আইনি পথ। বিচার ব্যবস্থাকে হাস্যকর জায়গায় নামিয়ে আনা জোনাথনের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিলেন আইনজীবীরা। বিনা পয়সায় মামলা দায়ের করার ক্ষমতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আদালত। আদালত বলেছিল জোনাথনের দায়ের করা বেশিরভাগ মামলাই ভিত্তিহীন। জোনাথনের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল আদালত। এরপর মানসিক চিকিত্‍সার জন্য জোনাথনকে পাঠানো হয়েছিল কেন্টাকির লেক্সিংটনের ফেডারেল মেডিক্যাল সেন্টারে। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন জোনাথন লি রিচেস। ফিরে গিয়েছিলেন বাবা মায়ের কাছে। আদালতের রায়ে জোনাথনকে নজরবন্দি হয়ে থাকতে হবে পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর তিনি পুলিশের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনও শহরে যেতে পারবেন না। এছাড়া জোনাথনকে মাসে ২০০ ডলার করে দিয়ে, মেটাতে হবে ৯২৬৮০ ডলার ফাইন।

আততায়ী অ্যাডাম ল্যাঞ্জা পুলিশ তদন্ত চালিয়ে বুঝতে পেরেছিল আততায়ী অ্যাডাম ল্যাঞ্জার কাকা আর কেউ নন, দুনিয়ার সেরা মামলাবাজ জোনাথন লি রিচেস। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় জন্য ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে ভুলপথে পরিচালনা করার জন্য আবার গ্রেফতার করা হয়েছিল জোনাথনকে। সাড়ে পাঁচ বছরের জন্য পাঠানো হয়েছিল কারাগারে। ফাইন করা হয়েছিল ১৩২০ ডলার। কারাগার থেকে বেরিয়ে, বাছাই করা মামলাগুলি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন জোনাথন। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত বইটির নাম ‘Nothing is Written in Stone: A Jonathan Lee Riches Companion’। বইটি তাঁর আত্মজীবনীও। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল বইটি। শোনা যায় জোনাথনের করা ক্ষতিপূরণের মামলা ও বই বিক্রি থেকে জোনাথন এ পর্যন্ত আয় করেছেন প্রায় আশি লক্ষ ডলার। তাঁর দায়ের করা মামলার সংখ্যা আজ ৩০০০ ছুঁয়েছে।

ট্রাম্পের একনিষ্ঠ ভক্ত জোনাথন লেখার শেষ করব একটি মজার ঘটনা দিয়ে। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জোনাথনকে একটি টিভি শোতে ডাকা হয়েছিল। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন কেউ প্রেম করেননি আপনার সঙ্গে?’ প্রশ্নটি শুনে জোনাথন হাসতে শুরু করেছিলেন। তারপর হঠাত্‍ই টিভি শো ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এর কয়েকদিন পর টিভি চ্যানেলটি উকিলের চিঠি পেয়েছিল। তাঁকে স্টুডিওতে ডেকে জনসমক্ষে অপমান করার জন্য চ্যানেলটির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করে দিয়েছিলেন জোনাথন। এই মামলায় জিতে পঞ্চাশ হাজার ডলার আদায়ও করেছিলেন দুনিয়ার সেরা মামলাবাজ জোনাথন লি রিচেস।

গাজীপুর কথা