ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

তিন দফা বেঁচে ফেরার গল্প শোনালেন বীর বিক্রম আবুল কালাম

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১২ ডিসেম্বর ২০২০

তিন দফা বেঁচে ফেরার গল্প শোনালেন বীর বিক্রম আবুল কালাম

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও মনে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এমন স্মৃতি লালন করাসহ হানাদারদের নির্দয় নির্যাতন আর নিপীড়নের বর্ণণা দিলেন তিন দফায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বীর বিক্রম।

টাঙ্গাইল করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবে নেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তারা। যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে জেলার অসংখ্য স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি।

এরই ধারাবাহিকতায় ৭১এর ১৭ আগস্ট রাতে তিনি দ্বায়িত্ব পান টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তারটিয়া ভাতকুড়া এলাকায় একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ধ্বংসের। এ কাজে অংশগ্রহণ করেন তিনি ও নজরুল ইসলাম বাকু নামের আরেক সহযোদ্ধা।

তবে বৃষ্টির কারণে ওই বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ধ্বংসে ব্যর্থ হন তারা। রাতে ওই গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাদের আশ্রয় নেয়া বাড়িটি ছিল রাজাকারের। ভোরে তারা বাইরে এলে স্থানীয় মোতালেব ড্রাইভার, রশিদ ভেন্ডার ও ঠান্ড বা মন্টু নামের আরও একজন তাদের পিছু নেয় ও পথরোধ করেন। তখন তাদের অবস্থান ছিল তারটিয়া ভাতকুড়া এলাকার ঢাকা রোডে। এর কিছুক্ষণ পরই তারা দেখে তিনদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেছে পাকিস্থান আর্মি, পুলিশ আর রাজাকাররা।

এদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক থেকে দেড়শ। এ সময় তাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে ঘিরে ফেলা বাহিনী। এরপরও তারা বিচলিত না হয়ে গ্রেনেড আর গুলি ছুড়ে অবস্থান ত্যাগের চেষ্টা চালান।

তবে এরই মধ্যে পাকবাহিনীর ছোড়া একটি গুলির স্পিন্টার তার চোখের নিচে আর একটি গুলি পায়ে লাগে। এতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরতেই দেখেন পাকবাহিনীর সদস্যরা তাকে ঘিরে ফেলেছে। এ অবস্থাতেও তারা তার ওপর চালাতে শুরু করে রাইফেলের বাড়ি আর বুটের লাথি।

ওই স্থানে খালে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাকুর কাছে নিয়ে যায় তাকে। এরপর থানা পাড়ার ইকবাল নামের এক রাজাকার গুলিবিদ্ধ বাকুর ওপর নয়টি গুলি চালায় ও তার বুকে রাইফেল তাক করে।

তিনি বলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতি করার কারণে অনেকেই তাকে চিনতেন। এ সময় রাজাকার সদস্যদের করটিয়ার সা’দত কলেজে পড়ুয়া এক ছাত্র ওই স্থানে থাকা পাকিস্থান আর্মির একজন ক্যাপ্টেনকে বলে ওর কাছ থেকে তথ্য বের করা যাবে, তাই ওকে এখনই মারার দরকার নেই। এ কারণে ওখানে আমাকে না মেরে আনা হলো সার্টিক হাউসে, এরপর থানায়। আটক থাকা দুইদিনে আমার উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।

এরপর ১৯ আগস্ট ভোরে দ্বিতীয় দফায় আবার আমাকে মেরে ফেলার জন্য নেয়া হয় বদ্ধভূমিতে। তবে এ সময় সার্কিট হাউসে উপস্থিত হন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও সিএনএন’র সাংবাদিকরা। এ কারণে তাকে বদ্ধভূমি থেকে সার্কিট হাউসে ফেরত নেয়ার আদেশ দেন পাকিস্তান আর্মির একজন কর্নেল।

সার্কিট হাউসে উপস্থিত ওই সাংবাদিকরা আমাকে অস্ত্রসহ আটকের তথ্য সংগ্রহসহ আমার ভিডিও ধারণ করেন। এর ফলে দ্বিতীয় বার বেঁচে যাই আমি। তবে এরপরও আমাকে ছেড়ে না দিয়ে নেয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানেও চলতে থাকে ধারাবাহিক নির্যাতন।

মাঝপথে নেয়া হলো ক্যান্টনমেন্টের সাইনালি ইন্টারগেশন ইউনিটে। যেখান থেকে কেউ কখনও জীবিত ফেরেনি। ক্যান্টনমেন্টের সাইনালি ইন্টারগেশন ইউনিটে আমাকে ইন্ডিয়ার চর বানানোর চেষ্টা চালায় পাকিস্তানি আর্মিরা। তারা আমাকে ভারতীয় সেনা সাজিয়ে পাকিস্তানি আর্মির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি এমনটা সাজানোর চেষ্টায় জিজ্ঞাসাবাদ চালাতে শুরু করে।

এই জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে তারা একটি পেপারে আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলে। তবে ইতোপূর্বে আমি ইন্টারগেশন করায় ওই পেপারে স্বাক্ষর দিইনি। এ কারণে তারা আমাকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে আমার দুই পায়ের পাতা দিয়ে গরম লোহার রড ঢুকিয়ে নির্যাতন শুরু করে।

এ নির্যাতন চলাকালে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় কিছু স্মরণে নেই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আবার আমাকে আনা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট সেলে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট সেলে আটক বন্দিরা আমাকে জানায় সাইনালি ইন্টারগেশন ইউনিটে গিয়ে কেউ আর জীবিত ফিরে আসে না। তবে সেখান থেকে আমি আর আরেকটি যুবক জীবিত ফিরে এসেছি।

পাকিস্তানি আর্মির সাইনালি ইন্টারগেশন ইউনিট সম্পর্কে তিনি বলেন, ১০-১২ ফিট প্রসস্থের ওই ঘরে বৈদ্যুতিক চুলাসহ ছিল নির্যাতন চালানোর সকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি।

ইন্টারগেশন ইউনিট থেকে আবার নেয়া হয় রেডিও পাকিস্থান ঢাকা সেন্টারে। সেখানে নেয়া হয় আমার সাক্ষাৎকার। সেখানে রিজিওনাল ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের একজন বাঙালি।

তিনি আমাকে বুদ্ধি দিলেন ও বললেন, ‘আমার কাছে খবর আছে এখান থেকে নিয়ে তারা আপনাকে মেরে ফেলবে। এ কারণে তারা জিজ্ঞাসা করলে আপনি তাদের বলবেন, কাদের সিদ্দিকী আমাকে জোরপূর্বক ওই বাহিনীতে আটকে রেখেছে। তাহলে কপাল ভালো থাকলে আপনি বাঁচতে পারেন।’

তার পরামর্শ মতই আমি তাদের বলেছি আমি ইচ্ছাকৃত মুক্তিযুদ্ধে যাইনি, কাদের সিদ্দিকী আমাকে জোরপূর্বক বাহিনীতে নিয়েছেন। এই মিথ্যাটুকুর জন্য তারা আমাকে না মেরে কয়েকদিন সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। তবে আমার সঙ্গে থাকা একজন কৃষক আর এক ছাত্রের সাজা হয় মৃত্যুদণ্ড।

তাই আমার ধারণা ছিল, যারা মুক্তিযোদ্ধা না তাদের সাজাই যখন মৃত্যুদণ্ড সেখানে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা আমি। আমার সাজা তো নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড। কিন্তু আমার সাজা হয় ১৪ বছরের জেল আর ১৫টা বেতের বাড়ি।

তবে আমার ধারণা বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ায় আমার সংবাদ প্রচার পাওয়ায় আমার সাজা মৃত্যুদণ্ড হয়নি।

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেল থেকে ছাড়া পান এই মুক্তিযোদ্ধা। এরপর ১০ জানুয়ারি ছাড়া পান বঙ্গবন্ধু আর ২৪ জানুয়ারি বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দেন দেশের প্রথম জেলা টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন