ঢাকা,  মঙ্গলবার  ২৩ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

গয়না যখন গুপ্ত হত্যার অস্ত্র!

প্রকাশিত: ১২:৩৪, ১৩ জুলাই ২০২০

গয়না যখন গুপ্ত হত্যার অস্ত্র!

প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রতিনিয়তই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানা নিদর্শনের খোঁজ চালাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমেই আমরা অতীতের বিভিন্ন সভ্যতা ও মানুষের জীবনযাপন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কিংবা রীতিনীতির বিষয়ে জানতে পারি। 

অতীত সম্পর্কে জানার আগ্রহ মানুষের বরাবরই। কারণ বর্তমান পৃথিবী অনেক আধুনিক, তাই জীবন ধারণ অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। তবে অতীতে বিশ্ববাসীর মধ্যে ছিল নানা কুসংস্কার। তাদের জীবনযাত্রাও ছিল অনেক রহস্যময়। তেমনি এক বিষয় নিয়ে থাকছে আজকের লেখা-

বুলগেরিয়ার প্রত্নতত্ত্ববিদরা সম্প্রতি একটি মধ্যযুগীয় আংটি আবিষ্কার করেন। বুলগেরিয়ার কৃষ্ণ সাগর উপকূলে কাভার্ন শহরের নিকটবর্তী কেপ কালিয়াক্রায় একটি মধ্যযুগীয় দুর্গের ধ্বংসাবশেষ খননের সময় এই আংটির সন্ধান মেলে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এর আকার আকৃতি দেখে যথেষ্ট অবাক হয়েছিলেন। কারণ এটি কোনো সাধারণ আলঙ্কারিক টুকরো ছিল না। এর নকশা দেখে তাদের মনে হয়েছিল বিভিন্ন অপরাধ এমনকি খুনের মতো ঘটনাও এর দ্বারা সংঘটন সম্ভব ছিল। 

মধ্যযুগীয় এই আংটিটি ২০১২ সালে আবিষ্কৃত হয়। এটি একটি পাত্রের মধ্যে ছিল। সেখানে একটি রিংস্টোনও ছিল। উদ্ধারকৃত আংটিতে একটি ছোট গর্ত দেখতে পায় গবেষকরা। যেখানে বেশ কয়েক ফোটা তরল বস্তু রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ধারণা করা হয়, আংটির এই গর্তের ভিতরে বিষ রেখে অভীষ্ট ব্যক্তির খাবার কিংবা পানিতে মিশিয়ে দেয়া হত।  

 

উদ্ধারকৃত আংটি

উদ্ধারকৃত আংটি

গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য সোফিয়ার জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট এবং জাদুঘরের উপপরিচালক বনি পেট্রোনোভা এই আংটি নিয়ে গবেষণা করেন। তার মতে, এই আংটির গর্তটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা। আংটির নির্মাণ কৌশল দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি ডান হাতে পরা আর আংটিতে থাকা বিশেষ গর্তটি একেবারেই লুকায়িত থাকত। বোঝারও উপায় থাকত না সেখানে কি রাখা আছে। সুযোগ মতো খুব দ্রুত আংটির গর্তে লুকিয়ে রাখা বিষ খাবার কিংবা পানিতে মিশিয়ে দেয়া যেত। 

বনি পেট্রোনোভার মতে, এই বিশেষ নকশার আংটি সময় সাপেক্ষে ব্যবহার করা হত। নিয়মিত এটি ব্যবহারের প্রমাণ বিশেষজ্ঞরা পাননি। বুলগেরিয়ায় পাওয়া এই আংটি এমন অস্ত্রের প্রথম নিদর্শন হিসেবে ধারণা করা হয়। এটি আবিষ্কৃত হয়েছে যে স্থান থেকে সে অঞ্চল একসময় অভিজাত শ্রেণির বসবাস ছিল। 

অনুমান করা হয়, এই আংটি ১৪ শতাব্দীর শেষার্ধে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্য ব্যবহৃত হত। স্বাধিকারের শাসক হিসেবে পরিচিত ডোবারোটিটসা এবং তার পুত্র ইনভাকো টের্টার এর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিরোধের কারণেই অনেক অভিজাত ব্যক্তি রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছিল। 

ডোবারোটিটসার শাসনকাল ছিল ১৩৪৭ থেকে ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। বুলগেরিয়ায় পাওয়া আংটির নকশা দেখে গুপ্ত হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্য ব্যবহারের বিষয়ে বেশিরভাগ গবেষক একমত হয়েছেন। তবে এর বহুকাল পূর্বেও এ ধরণের আংটির ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। 

ধারণা করা হয়, বিষ রাখা আংটি হাতে পরার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে আত্মহত্যা করা। শত্রুর নির্যাতন কিংবা অপমান থেকে রক্ষা পেতে আংটিতে বিষ রেখে আত্মহত্যা করত বিশেষ ব্যক্তিরা। হ্যানিবল প্রাচীনকালের বিখ্যাত কার্থেজ সেনাপতি ছিলেন। তিনি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন। রোমানদের হাতে নিগৃহত হওয়া থেকে মুক্তি পেতে ১৮১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। 

 

বিষ রাখা হত এই আংটিতে

বিষ রাখা হত এই আংটিতে

ধারণা করা হয়, তার আংটিতে রাখা বিষ পানেই তিনি আত্মহত্যা করেন। ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিক বক্তা ডেমোসথেনেস খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দে ক্যালাউরিয়া দ্বীপে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। পুনরায় বন্দি হওয়ার আশঙ্কা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তার কাছে একটি ফাঁপা আংটি ছিল বলে জানা যায়। ওই আংটিতেও তিনি বিষ লুকিয়ে রেখেছিলেন। 

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বুলগেরিয়ায় বিষ প্রয়োগে একজন শাসকের হত্যার ঘটনা ঘটে। আংটিতে বিষ রেখে আত্মহত্যা কিংবা হত্যার আরো অনেক উদাহরণ আছে। শত্রুকে হত্যা করতে বিষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন অষ্টম শতকে বেড়ে যায়। 

অষ্টম শতাব্দীতে আরবীয় রসায়নবিদ আর্সেনিকের একটি ধরণ থেকে বিস্ময়কর বিষ আবিষ্কার করেন। যা শনাক্ত করা যেত না। প্রাণঘাতী এই যৌগ স্বাদহীন এবং গন্ধহীন ছিল ফলে যার উপর প্রয়োগ করা হত সে বুঝতেই পারত না। সেকারণেই এটি গুপ্ত হত্যার জন্য খুবই কার্যকর অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হত। 

এর কয়েক শতক পরে বিষের আংটি, ছুরি, চিঠি এমনকি লিপস্টিকও ব্যবহৃত হতো হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্য। গুপ্তহত্যার জন্য এভাবেই বিষ প্রয়োগ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত প্রচেষ্টা হিসেবে প্রচলিত হয় সে সময়।  

গাজীপুর কথা