ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় রেশম চাষে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৫ নভেম্বর ২০২০

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় রেশম চাষে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণে দুটি গ্রামে রেশম চাষে বহু কৃষক পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে।

এক সময় যে নারীদের দুপুরে অলস সময় কাটত, এখন তারা রেশম উৎপাদনের কাজে ডুবে থাকেন। তাতে পরিবারে আসছে বাড়তি আয়।

গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড। তারা বিনামূল্যে কৃষক পরিবারে রেশম গুটি দিচ্ছে। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায় তুঁত গাছ রোপন করছে। রেশম গুটি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে। গুটি উৎপাদনের পর তা কৃষকদের কাছ থেকে কিনেও নিচ্ছে।  

২০১৪ সাল থেকে কাপাসিয়ার রায়েদ ইউনিয়নের ‘বরহর’ ও করিহাতা ইউনিয়নের ‘দিঘিরকান্দা’ গ্রামের অর্ধশতাধিক নারীকে তাদের বাড়িতে পলু [লার্ভা] ঘর নির্মাণসহ রেশম পালনে আনুসাঙ্গিক সামগ্রী বিতরণ করে আসছে রেশম বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে বরহর ও দিঘিরকান্দা গ্রাম ঘুরে নারীদের রেশম চাষের কর্মযজ্ঞ দেখা গেছে। বাড়িতে বাড়িতে এখন তৈরি হয়েছে রেশম চাষের পলু ঘর।
গাজীপুরের আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের অধীন গাজীপুরের কাপাসিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে রেশম চাষ হচ্ছে বলে জানান কাপাসিয়া রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সুপারভাইজার গোলাম ছহুরুল আলম।

তিনি বলেন, সমন্বিত প্রকল্পের অধীনে রেশম চাষে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের এই চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বরহর ও দিঘিরকান্দা গ্রামের ৬৪ জন নারীর বাড়িতে পলু ঘর নির্মাণসহ যাবতীয় আনুসাঙ্গিক সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

রেশম পোকার খাবারের জন্য স্থানীয় বরদার খালের উভয় পাশে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় তুঁত গাছ রোপন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, লাভজনক এই রেশম চাষে এলাকার বহু নারী স্বাবলম্বী হওয়ায় অনেকেই এ চাষে ঝুঁকছেন। এই এলাকায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে রেশম চাষ। সরকারি এই কর্মসূচির বাইরে গ্রামের আরও শতাধিক পরিবারের নারীরা রেশম চাষে নিজেদের পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। তাদের সহায়তায় রেশম বোর্ড থেকে চলতি বছরে বাড়ি বাড়ি তুঁত গাছ রোপনের জন্য বিনামূল্যে দেড় হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে।
প্রতিটি বাড়িতে রেশম কীট (লার্ভা) বিতরণ থেকে গুটি তৈরি পর্যন্ত সবকিছু রেশম বোর্ড তদারকি করে জানিয়ে তিনি বলেন, পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকদের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে নিয়ে সুতা উৎপাদন করা হয়।

ছহুরুল আলম জানান, বছরের জ্যৈষ্ঠ, ভাদ্র, অগ্রহায়ন ও চৈত্র মাসে রেশম গুটি সংগ্রহ করা হয়। কৃষকদের রেশম পোকার ডিম দেওয়ার পর কয়েকদিনেই পোকা তৈরি হয়। পরে তুঁত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে পোকার খাবার সরবরাহ করা হয়। এই পাতা খেয়ে পোকাগুলো ২০/২৫ দিনের মধ্যেই গুটি তৈরি করে। এই গুটি থেকেই তৈরি হয় রেশম সুতা।

গাজীপুর জোনাল রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করতে রেশম চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ রেশম শিল্প সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সমন্বিত প্রকল্পের আওতায় কাপাসিয়ায় প্রায় অর্ধশত সুবিধাভোগী রেশম চাষ করছেন। প্রতি তিন মাসে তাদের ৭/৮ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। রেশম চাষের মাধ্যমে গাজীপুরের কাপাসিয়ার কয়েকশত নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন।”

নিজ বাড়িতে সংসারের কাজের ফাঁকে এই চাষে সামান্য সময় দিয়ে প্রতিবছর ২৫/৩০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করতে পারেন বলে তিনি জানান।

গুটি চাষের সময় সম্পর্কে তিনি বলেন, তুঁত গাছ চারা থেকে পরিণত হতে ২/৩ বছর সময় লাগে। পলু ঘরে রেশম পোকার সঙ্গে পর্যাপ্ত তুঁতপাতা থাকলে ২০/২৫ দিনের মধ্যে গুটি পাওয়া যায়। গুটি তৈরি হওয়ার ৩/৪ দিন পর রোদে শুকিয়ে নিতে হয় যাতে ভেতরের পোকা মারা যায়। পরে তা বিক্রির উপযোগী হয়।

“১০/১২ কেজি গুটি থেকে এক কেজি সুতা উৎপাদন করা যায় এবং বর্তমানে এক কেজি সুতা ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।”

তিনি আরও জানান, রেশম চাষের প্রধান রসদই হচ্ছে পোকার খাবার তুঁত গাছের পাতা। রেশম পোকার খাবার সরবরাহের জন্য সরকারি বিভিন্ন খাল ও নদীর ধারে তুঁত গাছ রোপন করা হচ্ছে। এতে কোনো জমিরও অপচয় হচ্ছে না।
বরহর গ্রামের জাহেদা আক্তার বলেন, তার স্বামী মাঠে কাজ করেন। সংসারের রান্না-বান্নার কাজ শেষে তাকে বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হতো। স্বামীর স্বল্প আয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের নানা খরচ যোগানে সমস্যা হতো।

তিনি পাঁচ বছর আগে তিনি রেশম চাষ শুরু করেন জানিয়ে বলেন, অবসর সময়টুকুতে রেশম চাষের মাধ্যমে এখন প্রতিবছর তিনি নিজে ১৫/২০ হাজার টাকা সংসারের যোগান দেন। এতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চলানোসহ সংসারের অন্য খরচও করতে পারেন।

একই গ্রামের আরেক গৃহবধূ শিল্পী রানী বলেন, সংসারের অলস সময়ে ঘরে বসে একজন নারী হিসেবে বাড়তি আয় করতে পারছেন তিনি। আগে নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য স্বামীর হাতের দিতে তাকে চেয়ে থাকতে হতো। এখন ঘরে বসেই তিনি আয় করতে পারেন। নিজের ও সন্তানদের খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতেও টাকা তুলে দিতে পারেন। এভাবে নিজের স্বাবলম্বী হওয়াটা তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়।

তাদের পল্লিতে অন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরাও এখন রেশম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে তিনি জানান।

দিঘিরকান্দা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, কিছুদিন আগেও অভাবের সংসার ছিল তার। অভাব মোচনে তার স্ত্রী রেশম চাষ শুরু করেন। তিনি মাঠে কাজ করেন আর তার স্ত্রী বাড়িতে রেশম ও গবাদি পশু পালন করেন। এতে কয়েকবছরেই তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

গাজীপুর কথা