ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ২৫ জুলাই ২০২০

খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদ চৌধুরীকে ‘ফেরত দেয়ার উদ্যোগ’ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই উদ্যোগ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের মামলাটি আবার চালু করার মাধ্যমে এই খুনীকে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পত্রিকা পলিটিকোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগের কথাটি। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ সফল হলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আরও একটি কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন হবে বাংলাদেশের। খুনী রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে এখনও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পাঁচজন পলাতক। খুনীদের ধরিয়ে দিতে রেড নোটিস জারি করা আছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের। কূটনৈতিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পত্রিকা পলিটিকোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১৫ বছর আগে নিষ্পত্তি হওয়া এই মামলা এখন আবার চালু করে রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। গত জুন মাসে আলোচিত এই মামলাটি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। গত ১৭ জুন এ্যাটর্নি জেনারেল বার রাশেদ চৌধুরীর মামলাটি তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন ‘বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপীল’কে। রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুমতি বাতিল করতে চাইবেন এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বারই। উইলিয়াম বারই সফল হলে শুরু হবে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া।

খুনী রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবী মার্ক ভ্যান ডে’র হাউট যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পত্রিকা পলিটিকোকে বলেন, অনেক আগে শেষ হওয়া একটি মামলা নিয়ে কেন এমন করা হচ্ছে সেটিই আমাদের কাছে প্রশ্ন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাশেদ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালে নিম্ন আদালতের রায়ে অন্য আসামিদের সঙ্গে পলাতক অবস্থায় তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত ১২ জন কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাতজনের রায় কার্যকর হলেও রাশেদ চৌধুরীসহ বিদেশে পলাতক অন্যদের দণ্ড কার্যকর হয়নি। রাশেদ চৌধুরী তার পরিবার নিয়ে ভ্রমণ ভিসায় ১৯৯৬ সালে আমেরিকায় যায়। দুই মাসের মধ্যে তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে। প্রায় দশ বছর পর সেই অনুমতি পায়। এরপর বাংলাদেশ নানাভাবে তাকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পলাতক খুনী তথা ফাঁসির আসামি রাশেদ চৌধুরীকে তুলে দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়েই মার্কিন মুলুকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানান বিদেশ মন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় তার কাছে মার্কিন বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পের একটি চিঠিও তুলে দেন। ওই চিঠিতে করোনার সঙ্কটকালেও মার্কিন নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর খুনী আবদুল মাজেদের ফঁািসর পরই বঙ্গবন্ধুর বাকি পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চেয়ে মার্কিন সরকারের কাছে ফের অনুরোধ জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা রাশেদ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। একাধিকবার জায়গা বদল করে ২০১৫ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী সেক্রামেন্টো থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কনকর্ডের হ্যাকলবেরি ড্রাইভে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে সে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নথিপত্র মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তাতে তার এই অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে। এমনকি গত বছরের নবেম্বর মাসেই মার্কিন বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পের কাছেও রাশেদ চৌধুরীর বিচারের যাবতীয় নথিপত্র পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও তারপরে এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি ট্রাম্প প্রশাসন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর চিঠি পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। এরপরই প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীর বিচারের নথিপত্র চেয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দফতর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি দেয়ার প্রক্রিয়া থেকেই খুনী রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত নথি চেয়ে মামলাটি খারিজ করে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া পলাতক খুনীদের দেশে ফেরানো নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে নানা চেষ্টা প্রক্রিয়ায় এবার পলাতক পাঁচ খুনীর একজনকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে। খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার জন্য এটা একটি কূটনৈতিক তৎপরতার অগ্রগতি যা উদ্যোগটির সফলতার অপেক্ষা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করে খুনীরা। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর এতে করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা ছাড়া পেয়ে যায়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খোলে। তখন বিচার শুরু হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারের গতি শ্লথ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দণ্ডিত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি)। মাজেদ গত ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর ঢাকায় গ্রেফতার হয় ৭ এপ্রিল। এর চারদিন পর ১১ এপ্রিল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পলাতক পাঁচ আসামি খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খান। তাদের মধ্যে নূর কানাডায়, রাশেদ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। গত ২২ এপ্রিল বুধবার খুনী মুসলেহ উদ্দিনকে আটকের ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের টিভি চ্যানেল এনডিটিভি। এর আগেরদিন মঙ্গলবার ভারতের ইংরেজী দৈনিক দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়, সম্ভবত মোসলেউদ্দিনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, ভারতের গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় মোসলেউদ্দিনকে উত্তর চব্বিশ পরগনায় একটি গ্রাম থেকে আটক করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনও সুনির্দিষ্ট কোন ঘোষণা না আসায় ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে কানাডায় বসবাসকারী বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে নানা ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটির আদালতের নিয়ম অনুযায়ী সেদেশে আশ্রয় নেয়া কোন ব্যক্তি আইনে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত হলে তাকে ফেরত পাঠানো নিষিদ্ধ। তবে নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কানাডার আদালতে বিচারাধীন একটি মামলার রায়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পক্ষে যাতে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে দেশে ফেরানোর পথ খুলতে পারে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।

সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর পলাতক থাকার বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিস জারি করা আছে। ২০০৯ সালে এই নোটিস জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে।

গাজীপুর কথা