ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৮ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

কৃষকের পুত্র এখন বিসিএস ক্যাডার আরিফুল

প্রকাশিত: ১৫:০১, ৯ জানুয়ারি ২০২১

কৃষকের পুত্র এখন বিসিএস ক্যাডার আরিফুল

প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও স্বপ্ন দেখেছেন বড় কিছু হওয়ার। সেই স্বপ্ন জয়ের পথে ব্যর্থও হয়েছেন বারবার। কিন্তু সেসব ব্যর্থতাকে পিছনে ফেলে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অবশেষে জয় করে নিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্যকে। হয়েছেন ৩৮তম বিসিএস-এর শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। 

বলছিলাম আরিফুল ইসলাম আপন-এর কথা। জন্মস্থান টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলায়। স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে। পিতা আ: জলিল পেশায় একজন কৃষক, মাতা মোসা: আসমা খাতুন গৃহিনী। নিম্নবিত্ত পরিবারেই বড় হয়েছেন আরিফুল ইসলাম। শত কাঁটাযুক্ত পথও আটকে রাখতে পারেনি সাফল্যকে। 

আরিফুল ইসলাম আপন বলেন, আর দশটা ছেলের মতোই আমার ছেলেবেলা কেটেছে দূরন্তপনায়। কৃষক বাবা, গৃহিণী মায়ের সাথেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কেটেছে। ছোট বেলা থেকেই ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। আমাকে ছাড়া গ্রামে কোনও খেলা বা টিম গঠন হতো না। গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে শিখেছি। আর সেই সংগ্রামই আমাকে সাফল্য এনে দিয়েছে।

নিজের স্বপ্নের বিষয়ে আরিফুল বলেন, স্কুলজীবনে ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীতে চাকরি করবো। সেই স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হই ধনবাড়ি নবাব ইনিস্টিশন স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে। এসএসসি তে ৪.১৩ পেয়ে ঐ স্কুল থেকে প্রথম স্থান অর্জন করি। যদিও ছাত্র হিসেবে আমি মধ্যম শ্রেণির ছিলাম। এরপর ভর্তি হই ধনবাড়ি কলেজে। কিস্তু কি একটা ভেবে আমি বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে মানবিক বিভাগে চলে আসি। ধনবাড়ি কলেজ থেকে মানবিকে সাড়ে ৪ পয়েন্ট পেয়ে পাশ করি। 

বিসিএস-এর স্বপ্ন নিয়ে আপন বলেন, স্কুল বা কলেজ জীবন থেকে বিসিএস-এর স্বপ্ন না থাকলেও তিতুমীর কলেজে অনার্স ৪র্থ বর্ষে পড়াকালীন অবস্থায়তেই মনের গহীনে বিসিএস-এর স্বপ্ন লালিত হতে থাকে। এর আগে টেরেই পাইনি আমার মাঝে লালন হচ্ছে বিসিএস নামক স্বপ্ন। 

সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণাদাতার বিষয়ে আরিফুল বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলো আমার বাবা-মা। বাবা-মার জন্যই আজ আামি এই পর্যন্ত এসেছি। বাবা-মা না থাকলে হয়তো আজকের এ জায়গায় আসা হতো না।

জীবনে বারবার ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তিতুমীরের এই ছাত্র বলেন, জীবনে বহুবার ব্যর্থ হয়েছি। অর্নাস শেষ করতেই সময় লেগেছে প্রায় ৬-৭ বছর। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটেছি। চোখের সামনে যে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখেছি সেখানেই আবেদন করেছি। কিন্তু প্রতিটি জায়গায়তেই ব্যর্থ হয়েছি। আমি যখন অনার্স ৪র্থ বর্ষে, তখন পিজ্জা হাটে চাকরি নিই। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতাম। কিন্তু মাথায় যখন বিসিএস-এর নেশা ঢুকেছে তখনই পিজ্জা হাটের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। এরপর ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষা দেই। সেখানেও ব্যর্থ হই। প্রিলিতেই ব্যর্থ হই। আর এটাই ছিল আমার সফলতার আগে শেষ ব্যর্থতা। ৩৮তম বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর আমি ৩টা সরকারি চাকরি পাই- প্রাইমারিতে সহকারী শিক্ষক পদে ও বাংলাদেশ ডাক বিভাগে।

ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো কি ছিল- জানতে চাইলে আরিফুল বলেন, জীবনে ব্যর্থ হওয়ার অনেক কারণ ছিল। সবচেয়ে বড় কারণ ছিল- নিজেকে চিনতে না পারা। আপনি যখন জীবনে সফল হবেন, ঠিক ঐ মূর্হূতে আপনার ব্যর্থতার কারণগুলো ধূলোয় মিশে যাবে। ব্যর্থতার ভাগ শুধুই নিজের। কিন্তু সফলতার ভাগ পুরো পৃথিবীর। সফল হতে হলে জীবনে জড়িয়ে থাকা অনেক ক্ষণস্থায়ী মানুষদের ত্যাগ করতে হবে। আর যখন থেকে আমি আমার জীবনের ক্ষণস্থায়ী মানুষদের ত্যাগ করে নিজেকে নিজের পরিবারকে সময় দিতে থাকলাম, ঠিক তখনই সফলতা এসে ধরা দিয়েছে।

সফল হতে হলে কোন বিষয়গুলো ত্যাগ করা উচিত বলে মনে হয়? এই প্রশ্নের জবাবে আপন বলেন, বিবিএস অন্যান্য চাকরি মতোই একটা চাকরির পরীক্ষা। তবে অন্যান্য চাকরি মতো এখানে কম পরিশ্রমের সুযোগ নেই। কঠোর পরিশ্রম করা ছাড়া জীবনে কোনও কিছুই আসে না। অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। হয় আপনাকে সময় নষ্ট করে জীবন নষ্ট করতে হবে, না হয় জীবন সুন্দর করতে হলে পড়াশোনা করতে হবে। দুটো কখনোই একসঙ্গে করা যাবে না। বিসিএস ক্যাডার হতে হলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে। আপনাকে আমোদ-প্রমোদ করা ত্যাগ করতে হবে। জীবনে থেকে অনেক কিছু তাড়িয়ে দিতে হবে। আর পড়াশোনাকালীন কোনও সর্ম্পকে জড়ানো যাবে না। আপনার সফলতা আনার ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় বাধাঁ হতে পারে। সফল হলে পছন্দের মানুষ এমনিতেই চলে আসবে। ব্যর্থ মানুষদের সঙ্গী কেউ থাকে না।

বিসিএস-এর জন্য পড়াশোনা ও প্রস্তুতি প্রসঙ্গে আরিফুল ইসলাম আপন বলেন, আমি প্রতিদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতাম। সকালবেলা ইংরেজি আর ম্যাথ ভালো মনে থাকে। সকাল ৬টা থেকে শুরু করে ১০টা পর্যন্ত ইংরেজি আর ম্যাথ করতাম। এরপর নাস্তা করে ব্যক্তিগত কাজ সেরে ১২টার দিকে আবার টেবিলে বসতাম একটানা বিকেল ৫টা পর্যন্ত পড়তাম। কত রাত জেগে পড়াশোনা করেছি হিসেব নেই। যেহেতু ব্যাচেলর বাসায় থাকতাম, কাজ থাকতো প্রায় সময়ই। তবুও পড়া বাদ দেইনি একদিনও। আমি নোট করে পড়তাম- কি কি পড়বো। গল্পের বই, পত্রিকা যখন যেটা ভালো লাগতো পড়তাম। পড়াশোনার বিকল্প নেই।

অনুজদের জন্য পরার্মশ প্রসঙ্গে আরিফুল ইসলাম বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেছি সরকারি তিতুমীর কলেজে। তিতুমীর কলেজের প্রতি আমার সব সময় আলাদা একটা টান কাজ করে। আমার স্নেহের ছোট ভাইদের পরামর্শ দিবো- যদি জীবনে সফল হতে চাও, তবে পরিশ্রম করো। বিসিএস-এর জন্য ১ম বর্ষ থেকেই উঠে পড়ে লেগে যাওয়ার দরকার নেই। একাডেমিক পড়াশোনার ফলাফলের অনেক মূল্য। 

পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নিজের ভিত্তিটা শক্ত করা। ৯ম ও ১০ম শ্রেণির ইংরেজি, ম্যাথ ও বাংলা ব্যাকরণে চোখ বুলিয়ে যাবে। অনেকে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করে, আসলে তা ঠিক নয়। কারণ অনেক সাধারণ জ্ঞান নতুন নতুন তথ্য নিয়ে আসে, প্রতিনিয়ত পাল্টায়। কিন্তু ম্যাথ, ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণ কিন্তু পাল্টায় না। ৪র্থ বর্ষে উঠে বা অনার্স শেষ করে এর প্রস্তুতি নেয়া যাবে। পারলে এক বা দুইটা টিউশনি করানো যেতে পারে চর্চার জন্য। একটা কথাই বলবো- সফলতার কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই, সফলতার পথ কঠিন ও কাঁটাযুক্ত। যে এই পথ অতিক্রম করতে পারবে, সেই সাফল্যের স্বাদ পাবে।

সফল হতে হলে যে- পরিশ্রম, ত্যাগ আর আত্মবিশ্বাস বড় মূলধন। সেটাই করে দেখিয়েছেন তিতুমীর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম আপন।

লেখক- শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।

গাজীপুর কথা