ঢাকা,  শনিবার  ২০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

এবারের হজ হোক করোনামুক্ত পৃথিবীর প্রার্থনায়

প্রকাশিত: ১৫:৩০, ৮ জুলাই ২০২০

এবারের হজ হোক করোনামুক্ত পৃথিবীর প্রার্থনায়

এসেছে হজের মৌসুম। মুমিন হৃদয়ে কাবা প্রদর্শনের আকুতি। আল্লাহর দরবারের সম্মিলিত হাজিরা দেয়ার মুহূর্ত। তবে বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এবার হজ পালন হবে সীমিত পরিসরে কঠোর বাধ্য বাধকতার মাঝ দিয়ে।
মহামারি করোনার কারণে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কিছু কাজে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে নিরাপদ হজ সম্পাদনে বদ্ধপরিকর সৌদি কর্তৃপক্ষ। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সাধারণ মানুষ হজে যেতে পারছে না। তবে আল্লাহর ঘর তাওয়াফে ব্যাকুল হাজিদের মন পড়ে থাকবে মক্কা মদিনায়। কাঁদবে মন কাবা প্রেমে। 

আল্লাহর ঘরের প্রতি এ প্রেম আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের যুগ যুগ ধরে চলমান একটি ঐতিহাসিক ধারা। শুরুটা হয়েছিলো হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর হাত ধরে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.)। মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ একজন নবী। মুসলিম জাতির আদর্শিক পিতা। আল্লাহ তায়ালা তাকে বহুভাবে পরীক্ষা করেছেন। তিনি সব পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল কোরআন থেকে সেসব ঘটনা আমরা শুনেছি। আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রাম চিরস্মরণীয়। মুসলিম উম্মাহকে তার আদর্শ থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে। 

আল কোরআনে বিবৃত হয়েছে ‘তোমাদের জন্য ইব্রাহিম ও তাঁর সঙ্গীদের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলো, আমরা তোমাদের থেকে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত কর, ওদের থেকে সম্পর্কহীন। আমরা তোমাদের মানি না। তোমাদের ও আমাদের মাঝে চিরকালের জন্য প্রকাশ্য শক্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যাবত না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন।’ তারপর বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা: মুমতাহিনা, আয়াত:৪-৬)।

আল্লাহ তায়ালার ইব্রাহিম (আ.) এর দেয়া পরীক্ষা ও কোরবানির দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপনের জন্য হজের বিধান দেয়েছেন। হজের আমলগুলোর প্রত্যেকটার সঙ্গে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সাফা, মারওয়া পাহাড়ে সায়ি করার সঙ্গে ছেলে ইসমাইল ও তার মায়ের পানির জন্য হাহাকারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। শয়তানকে পাথর মারা সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাবা ইব্রাহিমের (আ.) ছেলেকে কোরবানি করার ক্ষেত্রে শয়তানের প্ররোচনা ও পাথর মেরে শয়তানকে তাড়ানোর স্মৃতি। তাই হজের মূল হচ্ছে, আল্লাহর জন্য সবকিছুকে কোরবান করা শিক্ষা গ্রহণ।

ইসলামের যে বিধানই হোক না কেন, তার মূলে থাকে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি। খাবারের পরে আমরা দোয়া পড়ি ‘সমস্ত তারিফ ওই সত্তার যিনি আমাদেরকে খাবার খাইয়েছেন এবং মুসলমান বানাইছেন।’ এর মধ্যেও মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধতা রয়েছে। তো হজের মূল রহস্য বা হেকমত আত্মার পরিশুদ্ধি। তবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও হজকে বিবেচনা করা যায়। হজের দ্বারা মুসলমানদের ঐক্য প্রকাশ পায় এভাবে যে, সাদা-কালো, আমির-ফকির, সুন্দর-কদাকার, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সম্ভ্রন্ত ও নিচু বংশ, নারী-পুরুষ, বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-ভাষী, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী, চারিত্রিক ও আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরষ্পর পার্থক্য থাকা সত্তেও সবাই এক আল্লাহর ডাকে লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক বলছে। সবাই এক রঙ ও ডিজাইনের ড্রেস পরছে। হজের বিধান সবাই একভাবে পালন করে যাচ্ছে। উচ্চারিত হচ্ছে সবার মুখে এক বাণী। 

আরাফা, মুজদালিফা, সাফা ও মারওয়া সর্বত্র ঐক্যের নমুনা। এক কাবাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে সবাই। কারো মাঝে কোনো ভিন্নতা নেই। ধনী-গরিব, সাদা-কালো সবাই সমান, সেই সাম্যের চেতনাও এখানে পাওয়া যায়। আরবের কুরাইশরা আরাফা হারাম শরিফের বাইরে ছিলো বলে সেখানে যেতো না। বরং হারামের সীমা তথা মুজদালিফায় থেকে যেতো। অন্যরা আরাফা পর্যন্ত পৌঁছত এবং সেখান থেকে তওয়াফের জন্য মক্কায় প্রবেশ করতো। সামান্য এই পার্থক্যটুকুও ইসলাম সহ্য করেনি। বরং কুরাইশদেরকে নির্দেশ দিয়েছে তোমরাও সেখান থেকে তওয়াফ করতে আস যেখান থেকে অন্য সব লোকেরা তওয়াফের জন্য আসে। তাই বলা যায় হজ ইসলামের অনুসারীদের ঐক্য ও সাম্যের প্রতীক।

ইসলামের প্রতীক সমূহের সম্মান প্রদর্শন হজের অন্যতম উদ্দেশ্যে:

প্রত্যেক জাতি বা ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু শিআর বা প্রতীক থাকে। যা দেখে বুঝা যায় সে অমুক ধর্মের অনুসারী বা অমুক রীতি অমুক ধর্মের। ইসলাম ধর্মেও এমন কিছু প্রতীক রয়েছে। সেগুলোকে সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সূরা হজের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ‘আর যে আল্লাহর প্রতীক সমূহকে সম্মান করবে, তো ওই সম্মান কলবের তাকওয়া থেকেই হয়ে থাকে।’ হজের মধ্যে ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত এমন কিছু নিদর্শন রয়েছে যেগুলো দর্শন করার দ্বারা বান্দার ঈমানের মাত্রা বেড়ে যায়। অন্তরে জ্বলে ওঠে মহব্বতের আগুন। কোনো বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জাগ্রত অন্তরে হজ আদায় করলে প্রতিটি কদমে কদমে আল্লাহর কুদরত দেখতে পায়। বান্দা যখন কাবা শরিফের সামনে দাঁড়ায় তখন মনে অনুভব হয়, কেমন যেন সে আল্লাহর চৌকাঠের সামনে মাথা নত করছে। কাবা শরিফের গিলাফ জড়িয়ে ধরলে অনুভব হয়, নিজেকে আল্লাহর রহমতের আচলে জড়িয়েছে। সাফা ও মারওয়াকে বলা হয়েছে আল্লাহর প্রতীক এবং হজে ওই পাহাড়দ্বয়ে সায়ি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মোট কথা, হজে আল্লাহর প্রতীকগুলোর প্রতি সম্মান দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

হজের ফজিলত সম্বলিত হাদিস সমূহ:

(এক) রাসূল (সা.) থেকে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, একবার ওমরা আদায়ের পর পুনরায় ওমরা আদায় করার দ্বারা দুই ওমরার মাঝের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর আল্লাহর নিকট হজে মাবরূরের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।

হজে মাবরূরের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম লেখেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইখলাসপূর্ণ হজ। আর যেহেতু সমস্ত আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে হালাল মাল দ্বারা সম্পন্ন হওয়া। তাই হজে মাবরূরের ক্ষেত্রে এই শর্তও প্রযোজ্য যে তা হালাল মাল দ্বারা সম্পন্ন হতে হবে। অনেকে জীবনের শুরু থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য টাকা সঞ্চয় করতে থাকে। দশ বছর পর বড় অংকের টাকা হলে তা বাস্তবায়ন করে। বুযূর্গদের আমল ছিলো, তারা জীবনের শুরু থেকে হজের জন্য টাকা সঞ্চয় করতেন। যখন হজের টাকা জমা হতো তারা আল্লাহর ডাকে লাব্বায়িক বলতেন। ওই হজ কতই না বরকতময় ও সৌভাগ্যের বিষয় হতো। বর্তমান সময়ে অনেকে হজ করেন। কিন্তু অর্থ হালাল নয়। তাহলে এর দ্বারা আধ্যাত্মিক শক্তি, নৈতিক বল ও আত্মার প্রশান্তি কোথা থেকে আসবে? তাই আমাদের মাঝে দেখা যায়, হজের আগে-পরে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। অথচ হজ কবুল হলে অবশ্যই তা দ্বারা জীবনাচারে অবশ্যই পরিবর্তন হতো।

(দুই) হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, যে লোক হজ করলো এবং হজের সময়ে কোনো খারাপ কথা বলেনি, কোনো গুনাহে লিপ্ত হয়নি ও কারো সঙ্গে ঝগড়াও করেনি তাহলে সে হজ থেকে ওই শিশুর মতো ফিরে আসবে যে নাকি আজই নিষ্পাপ অবস্থায় মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছে। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। 

উক্ত হাদিসে একদিকে হাজিদের ফজিলত বলা হয়েছে। অন্যদিকে মূলত হাজিদেরকে হজের সময়ের আমল সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা আল কোরআনেও দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হজের নির্দিষ্ট কিছু মাস রয়েছে। অতএব, ওই মাসগুলোতে যাদের ওপর হজ ফরজ তারা খারাপ কথা, গোনাহের কাজ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকবে।’ যারা হজের ব্যবস্থাপনায় থাকেন তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সম্মানিত হাজি সাহেবদের খেদমতের জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা। আর হাজিদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর রহমত, রহম ও দয়া লাভ করার দ্বারা নিজেকে গুনাহের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা। বর্তমানে দেখা যায় অনেক হাজি সাহেব হজ থেকে এসে নানা অভিযোগ ও গিবতে লিপ্ত হয়ে যান। হজরত থেকে লোকদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন। এগুলো হজের সঙ্গে যায় না। তাই ধৈর্য ও সবরের সঙ্গে সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করা চাই। ঝগড়া বিবাদ কোথাও কাম্য নয়।

হাজিদের দ্বারা গুনাহ মাফের দোয়া করানো ও করোনা মুক্তির প্রার্থনা:

ইবনে ওমর (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, যখন হাজিদের সঙ্গে দেখা হয় তোমরা তাকে সালাম দাও, তার সঙ্গে মোসাফাহ কর এবং সে ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার দ্বারা গুনাহ মাফের দোয়া করাও। কেননা, সে নিষ্পাপ। (মুসনাদে আহমদ)।

হাদিসে হাজিদের নিষ্পাপ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাদের প্রার্থনাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য ও প্রিয়। তাই এবারের হজ পালনকারী হাজিদের প্রতি আল্লাহর দরবারে বিশ্বকে করোনামুক্ত করার দোয়া চাই। হাজিদের প্রার্থনার সঙ্গে বিশ্ববাসীও নিজ নিজ ইবাদতগাহে রোনাজারি ও কায়মনোবাক্যে একই প্রার্থনা করবে। আগামীর কাবা প্রাঙ্গন যেন হয় বিশ্ববাসীর জন্য উম্মুক্ত এটাই স্রষ্টার দরবারে একমাত্র  তামান্না।

গাজীপুর কথা