ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ইসলামের সর্বপ্রথম প্রচার কেন্দ্র

প্রকাশিত: ১৪:০৬, ২২ আগস্ট ২০২০

ইসলামের সর্বপ্রথম প্রচার কেন্দ্র

ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর যখন গোপনে ইসলাম প্রচার শুরু হয় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজের বন্ধু মহলে এ দাওয়াত পেশ করেন, তখন হজরত আবু বকর (রা.) এর প্রচেষ্টায় কয়েকজন সাহাবি ইসলাম কবুল করে নেন।
এভাবে প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলতে থাকে এবং সত্যের পয়গাম এক থেকে অপরের কাছে পৌঁছাতে থাকে। এমনি করে ক্রমান্বয়ে ঈমান গ্রহণকারী সংখ্যা চল্লিশ গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু তখনও ইসলামি আন্দোলনের কোনো কেন্দ্রীয় অবস্থান ছিলো না যেখানে তাদের বৈঠক বসতে পারে। তাই মুসলমানরা হয় একা একা নামাজ পড়তেন অথবা কোনো পাহাড়ের গোপন কন্দরে নামাজ পড়ে নিতেন। কারণ,স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র গৃহও পড়শীদের আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ ছিলো না।

ক্রমান্বয়ে ইসলামি আন্দোলনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় স্থানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বাড়তে থাকে। আর এ প্রয়োজনীয়তার কাঁটা  হজরত আকরাম (রা.) ইবনে আকরামকে সমধীক পীড়া দিতে থাকে। কাজেই তিনি একদিন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আবেদন জানান, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার ওপর উৎসর্গিত হোক- আমার সুপ্রশস্ত বাড়ি সাফা পর্বতের পাদদেশে বাইতুল্লাহর নিকটে অবস্থিত। আমি আপনার জন্য সেটি দিয়ে দিচ্ছি যাতে মুসলমানরা ওখানে সমবেত হয়ে যা কিছু করতে চান, করতে পারেন। এ বাড়িতে প্রবেশ করে সে সাধ্য মুশরিকদের নেই।’

তিনি এ বাড়িটি শুধু ইসলামের তাবলীগের জন্য ওয়াকফ করে দেননি, বরং এ বাড়ির অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্যক অবগত। কাজেই তিনি এটিকে ওয়াকফের মর্যাদা দান করলেন যাতে করে বেচা-কেনা কিংবা উত্তরাধীকার থেকে নিরাপদ থাকে। তথাপি এই বাড়িটি তার ওফাতের পরেও তারই খান্দানের অধিকারে থাকে। এতে একটি উপাসনালয় (কুব্বা বা মসজিদ)- ও ছিলো। এ বাড়িটি কাবা শরিফের নিকটে এমন জায়গায় অবস্থিত ছিলো যে, লোকেরা হজের সময় সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করার সময়  বাড়ির দরজার সামনে দিয়ে অতিক্রম করতেন।

১৪৫ হিজরিতে দ্বিতীয় আব্বাসী খলিফা আবু জাফর মনসুর  একে হজরত আরকাম (রা.) এর পৌত্র আব্দুল্লাহ ইবনে ওসমান ও অন্যান্য উত্তরাধীকারগণের নিকট থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে খরিদ করে নেন। পরে এটি খলিফা মাহদির দাসী আল-খায়যাবানের হাতে চলে যায়। সে নিজের ইচ্ছা মতো এটি পুননির্মাণ করায়। অতঃপর সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এতে বেশ কিছু পরবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু তারপরেও জায়গটি সবসময়ই পবিত্র‘দারে আকরাম’নামেই অভিহিত হতে থাকে।

নিম্নে দারে আকরাম সম্পর্কে ডঃ হামিদুল্লাহ রচিত ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাজনৈতিক জীবন’ শীর্ষক গ্রন্থের ৭২ পৃষ্ঠা থেকে একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘এ কথা সঠিকভাবে জানা যায়নি যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরকাম (রা.) নামক সাহাবির বাড়িতে কখনো কি অবস্থায় অবস্থান নিয়েছিলেন। তার বাড়ির সম্ভবতঃ শহরের সামান্য দূরে কিন্তু আরকাম (রা.) এর বাড়িটি ছিলো কাবার একান্ত নিকটবর্তী সাফা পর্বতে অবস্থিত ছিলো, এতে প্রচুর জায়গা ছিলো। তা আজো রয়েছে এবং এ বাড়িতে যাবার পথে সংর্কীণ গলির কোনো কোনো জায়গায় বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে প্রশস্ত করা হয়েছে। এ পবিত্র ও বরকতময় বাড়িতে প্রচার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো এবং সম্ভবতঃ জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় হতো। সেখান থেকে বাইতুল্লাহ শরিফ দেখা যেতো।’

এ পবিত্র কেন্দ্র সম্পর্কে সফরনামা আরদুল কোরআনের ১৫১-১৫২ পৃষ্ঠা থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা যেতে পারে। গ্রন্থকার বলেন, ‘আমরা সে সড়কে চলতে লাগলাম যেটি সাফা পর্বতের পাশ দিয়ে উত্তরে মিনার দিকে চলে গেছে। তখনো আমরা সাফার কাছেই ছিলাম, শেখ সুলায়মান সড়কের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এই হলো দারে আরকামের অর্ধেক অংশ যা নতুন নির্মাণ উপলক্ষে এখন সড়কের নিচে পড়ে গেছে এবং বাকি অর্ধেক আশপাশের দোকানগুলোর মধ্যে একটি দোকানের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ইসলামি দাওয়াতের সমগ্র ইতিহাসে দারে আরকামের যে গুরুত্ব ও প্রাথমিকতা রয়েছে তেমনটি অন্য কোনো স্থানের নেই। এটি ছিলে সে জায়গা, যেখানে হিজরত প্রাক্কালে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম মক্কার কাফেরদের উৎপীড়ন-অনিষ্ট  থেকে বাঁচার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে সমবেত হতেন এবং আল্লাহ তায়ালার এবাদাত-উপাসনা করতেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দান করতেন। কোরআন মজিদের কোনো আয়াত বা সূরা নাজিল হলে এখানেই তা পড়ে শোনাতেন। হজরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় এ বাড়ির উল্লেখ হয়ে থাকে। কাজেই ইসলামের ইতিহাসে যে বাড়িটির এহেন গুরুত্বপূর্ণ  অবস্থান সেটি পুরোপুরিভাবে বিলীর হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখানে কয়েক বছর পূর্ব পর্যন্ত বাড়িটি অবস্তিত ছিলো। সমস্ত মুসলমান বাদশাহ ও শাসকবর্গ সব দিক দিয় এর হেফাজত করেছেন। এটিই সে জায়গা যেখানে দারে আরকাম অবস্থিত ছিলো।

প্রত্যেক যুগে এ  জায়গাটিতে কোরআন-হাদিসের শিক্ষার কোনো না কোনো ধারা অব্যাহত থাকে। এ দালানকোঠা ভেঙ্গেছে এবং পুননির্মিত হয়েছে কিন্তু তারপরেও জায়গাটি তাই ছিলো। সর্বশেষ এমারতটি ১৯৪৭ সালে আমরা যেটি নিজেরাও দেখেছিলাম সম্ভবতঃ নবম হিজরি শতকে সেটি নির্মিত হয়েছিলো। এর দরজায় তখনো ‘দারে আরকাম’ শব্দটি লেখা ছিলো।

এ আলোচনা ততক্ষণ পর্যন্ত শেষ হয় না যতক্ষণ না হজরত আরকাম (রা.) এর আলোচনা করা হয়। সুতরাং তার পিতা ছিলেন আবদে মানাফ যিনি বনী মখযূম গোত্রের সরদার মুগীরা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে মখযূমের এক ভাই আসাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনে মখযূমের পুত্র ছিলেন।

তিনি ঈমান এনেছিলেন হজরত আবু বকর (রা.) এর আন্দোলনে এবং সাবেকূনে আউয়ালূনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। কোনো কোনো রেওয়াত অনুযায়ী ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বাদশতম ব্যক্তি। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তার বয়স ছিলো ১৮ বছর। তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে সংঘটিত সব জিহাদে অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি অত্যন্ত পরহেজগার, সত্যবাদি ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। একবার তিনি সওয়াব লাভের উদ্দেশে বাইতুল মুকাদ্দাসে গিয়ে নামাজ আদায় করার নিয়ত করে অনুমতি লাভের জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্তের নামাজ মসজিদে হারাম অর্থাৎ বাইতুল্লাহ ব্যতীত পৃথিবীর সমস্ত মসজিদে হাজার ওয়াক্তের নামাজ অপেক্ষা উত্তম।’

তিনি ৫২ হিজরি এবং কোনো কোনো রেওয়াত অনুযায়ী ৫৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর কিংবা ৮৫ বছর। তার অসিওত অনুযায়ী তার জানাযার নামাজ পড়িয়েছিলেন মাদায়েন বিজয়ী হজরত সাদ ইবনে আবী ওক্কাস। তাকে বাকী নামক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।  আল্লাহ তার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করুণ। আমিন।

গাজীপুর কথা