ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

আফ্রিকানরা যখন ভারতের শাসক

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

আফ্রিকানরা যখন ভারতের শাসক

যুগ যুগ ধরে আফ্রিকানরা নানা কারণে বিতর্কিত। বর্ণবাদ, হিংস্রতা বিভিন্ন কিছু নিয়ে আলোচনায় এসেছে এরা। তবে জানেন কি? এদের পূর্বপুরুষ কিন্তু ভারতের উৎকর্ষে রেখেছে অনেক অবদান। বহুকাল ভারত শাসন করেছেন আফ্রিকান রাজারা। পৃথিবীর মহিমামণ্ডিত কিছু সভ্যতা যে কালো মানুষেরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটা তাদের উত্তরসূরিদের দুর্দশা দেখে আজ প্রায় ভুলতেই বসেছে মানুষ।

ইতিহাস বলে, প্রাচীন গ্রীস বা রোমের হাজার বছর আগে কালো চামড়ার কর্মঠ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষরা এই অঞ্চলে শক্তিশালী সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সিন্ধু উপত্যকায়। অনেক নৃতাত্ত্বিকের ধারণা, দ্রাবিড়দের পুর্বপুরুষ ছিলেন কালো আফ্রিকানরাই। পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে অস্ট্রেলয়েড জাতির সংমিশ্রণে দ্রাবিড় জাতি গড়ে ওঠে। তাদের সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসে ছিল এ ইতিহাসের সুস্পষ্ট প্রতিফলন।

ইথিওপীয়দের সঙ্গে (প্রাচীন) ভারতীয়দের খুব আত্মিক সম্পর্ক ছিল। ইতিহাস বিস্মৃত সুপ্রাচীনকালে ইথিওপীয়রা ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেছেন। এসব ইথিওপীয়দের নাগা নামে ডাকা হতো। নাগাদের হাতেই সংস্কৃত ভাষার জন্ম। নাগারা ছিলেন সামুদ্রিক অভিযাত্রী গোষ্ঠী ও দক্ষ নাবিক। তারা শুধু মধ্য ভারত নয়, বরং শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারেও নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। 

মহাভারতে আছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতকে নাগাদের রাজধানী ছিল অধুনা দক্ষিণাত্যে। তাদের স্থাপিত অন্যান্য শহর ছিল গঙ্গা এবং যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। দ্রাবিড়িয় আদি সাহিত্য চিল্লাপাথিকারামে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহাশক্তিশালী রাজ্যই ছিল নাগানাড়ু।

আরো পড়ুন: মৃত মানুষের মগজ খাওয়াই এই জাতির রীতি  

প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা তো জানা গেল, তবে কি মধ্যযুগের আগেই নাগাদের আফ্রিকীয় কালোদের ভারত শাসনের অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছিল? মোটেও তা নয়, বরং ইতিহাস বলছে মুসলিম আবির্ভাবের বহুকাল পরেও ভারতে কৃষ্ণাঙ্গরা প্রবল প্রতাপের সঙ্গেই রাজ্যশাসন পরিচালনা করেছেন। আজকের লেখায় সেই আফ্রিকান রাজাদের কথাই থাকছে। যারা কিনা বেশ আঁটসাঁট বেঁধেই রাজ্য পরিচালনা করতেন। চলুন জেনে নেয়া যাক তাদের সম্পর্কে- 

মালিক আনদিল খান সুলতান

 

মালিক আনদিল খান সুলতান

মালিক আনদিল খান সুলতান

১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা জয় করে হাবশি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী শাহজাদা খোজা বারবাক সম্পর্কে ইতিহাসে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে সিদি আফ্রিকীয় ছিলেন এবং তার পূর্বপুরুষ ইথিওপীয়, তা নিশ্চিত। সিদি হচ্ছে সিদ্ধি শব্দের প্রচলিত অপভ্রংশ। সোয়াহিলি ভাষার মূল শব্দটি হলো শিদি বা হাবশি। আজো এদের বংশধরেরা ভারত ও পাকিস্তানের নানা অঞ্চলে বসবাস করেন। পূর্ব আফ্রিকার বান্টু জনগোষ্ঠীরাই হাবশিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বলে অনুমান করা হয়।শাহজাদা খোজা বারবাক ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার বিশ্বস্ত এক আমাত্যের হাতে নিহত হন। তখন ক্ষমতায় আসীন হন মালিক আনদিল খান সুলতান।

 

তিনিই হাবশি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী

তিনিই হাবশি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী

সিংহাসনে বসার পর তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সাইফ উদ্দিন আবুল মুজাফফর ফিরোজ শাহ। তিনি একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ও সুযোগ্য রাজা ছিলেন। তার শাসনামলে বাংলায় সমৃদ্ধি এসেছিল। ফিরোজ শাহ ১৪৮৭ থেকে ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মসনদে আসীন ছিলেন। তার আমলে জারি করা মুদ্রার সুবাদেই শাসনকাল সম্পর্কে নিশ্চিত জানা গেছে। তিনি নিজ প্রজাদের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা তৈরি করেন। একইসঙ্গে ছিলেন খুবই দয়ালু ও প্রজাবৎসল।বিবলিওথিকা ইন্ডিয়া' গ্রন্থে তার প্রচুর ধনদৌলত দান-ধ্যানের উল্লেখ রয়েছে। গরিবদের জন্য তার সহমর্মিতা ছিল অতুলনীয়। 

জামাল আল-দ্বীন ইয়াকুত

 

দিল্লিতে রয়েছে তার একটি মূর্তি

দিল্লিতে রয়েছে তার একটি মূর্তি

দ্বিতীয় যে আফ্রিকান রাজার কথা বলছি তিনি জামাল আল-দ্বীন ইয়াকুত। রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজের অবস্থান সুসংহত করার যাত্রাটা দিল্লি রাজ্যেই শুরু করেছিলেন এই হাবশি। দিল্লির মুসলিম সুলতানেরা তাদের সেনা, হারেম এবং রাজকীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীতে সেকালে বহু পূর্ব আফ্রিকীয় দাস রাখতেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় দিল্লিতে তাদের প্রভাবও বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। রাজা না হলেও তার জীবন কোনো অংশেই কম নাটকীয় ছিল না। 

জামাল আল-দ্বীন যখন তার কর্মজীবন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লির মসনদে বসেন সুলতানা রাজিয়া। ১২৩৬ থেকে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকারী রাজিয়া ছিলেন দিল্লির প্রথম নারী সুলতানা। তিনি জামাল আল-দ্বীনকে খুবই পছন্দ করতেন। রাজিয়া এই হাবশিকে প্রথমে পদন্নোতি দিয়ে রাজসভার একজন আমির বানান, পরে তাকে আরো সম্মানজনক পদ বা রাজকীয় আস্তাবলের তত্ত্বআবধায়করূপে নিয়োজিত করেন।

 

প্রথম নারী শাসক রাজিয়ার সঙ্গে তার ছিল অবৈধ্য সম্পর্ক

প্রথম নারী শাসক রাজিয়ার সঙ্গে তার ছিল অবৈধ্য সম্পর্ক

জামালের কর্ম তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে রাজিয়া তাকে আমির-আল-খায়াল (বা অশ্বশ্রেণির নেতা) উপাধি দেন। পরবর্তীকালে দেন সর্বোচ্চ সম্মানজনক আমির-আল-উমারা উপাধি। এর অর্থ, সকল রাজ আমাত্যের (আমিরের) নেতা। একজন হাবশিকে এত মর্যাদা দেয়ায় এবং তার ওপর আস্থা রাখায় রাজিয়ার দরবারের তুর্কি অভিজাতবর্গ খুবই নাখোশ হন। একে নারী নেতৃত্ব, তার ওপর হাবশি গোলামকে মর্যাদা দেয়ার পরিক্রমা তাদের অহমিকায় আঘাত হানে। আমাত্যদের প্রকাশ্য বিদ্রোহের মুখে রাজিয়া ক্ষমতাচ্যুত হন, আর জামাল আল-দ্বীনকে হত্যা করা হয়। এর আগে জামাল আল-দ্বীন কিছুদিন রাজিয়ার সঙ্গে ভারত শাসনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। এজন্যই তাকে ভারত শাসনের আফ্রিকানদের ভূমিকায় স্মরণ করা হয়।

মালিক সারোয়ার

 

মালিক সারোয়ার

মালিক সারোয়ার

মালিক সারোয়ারও হাবশি  ছিলেন। দিল্লির কাছাকাছি আরেক সুলতানি মসনদ জোনপুরের প্রশাসক হিসেবে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন। দিল্লির সুলতানদের জন্য তিনি জোনপুর জয় করেন। ১৩৯৪ সালে দিল্লির সুলতান দ্বিতীয় নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলক তাকে জোনপুরের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৩৮৯ সালে তাকে খাজাহ-ই-জাহান উপাধি দেয়া হয়। আরো দেন সম্মানজনক মালিক-উস-শার্ক বা পূর্বের রাজা উপাধি।

গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মালিক দিল্লির শাসকের অধীনতা মানতেন না। তিনি একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে শাসন শুরু করেন। তিনি নিজে আতাবেক-ই-আজম উপাধি নেন। এরপর ইতাওয়াহ, কোলই ও কৌনজের বিদ্রোহ দমন করেন তিনি। কারা, আওয়াধ, সান্দিলা, ডালমাউ, বাহরিচ, বিহার ও তীরহুত অঞ্চল জয় করে নিজ রাজ্যের সীমানা বিস্তার করেছিলেন সারোয়ার। 

তার সামরিক রণকুশলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে জাজনগরের রাই এবং লক্ষ্মণাবতির শাসকবৃন্দ তার আনুগত্য স্বীকার করে নেন। উপহার হিসেবে পাঠান সুপ্রশিক্ষিত বেশকিছু যোদ্ধাহাতি। মালিক সারোয়ারের পালকপুত্র মালিক কারানফল তার পিতার পর মসনদে আসীন হন। তিনিই ছিলেন বিখ্যাত সুলতান মুবারক শাহ। সে আমলের চল অনুসারে তিনি নিজেই এই পদবি নিয়েছিলেন।জোনপুরের এই সুলতান বংশের অধীনে রাজ্যটি সারা ভারতে শিক্ষা, সাহিত্য ও ব্যবসা- বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বংশে পাঁচজন বিখ্যাত হাবশি সুলতান শাসন করেছেন। 

মালিক আম্বর

 

মালিক আম্বর ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান

মালিক আম্বর ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান

ইন্দো-আফ্রিকীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মালিক আম্বর। ধারণা করা হয়, ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে ইথিওপিয়ার হারার অঞ্চল তার জন্ম। এরপর তাকে দাস ব্যবসায়ীরা গুজরাটের এক মুসলিম বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। ক্রীতদাস হলেও আম্বরকে শিক্ষা- দীক্ষা ও অন্যান্য শাস্ত্রে প্রশিক্ষিত করেন তার মনিব। ভারতে আসার পর পরবর্তীকালে সেটি তার কাজে লেগেছিল।

আরো পড়ুন: স্বামীসহ ৩০০ পুরুষকে হত্যা করেন এই নারী  

দক্ষিণ ভারতের আহমেদানগরের সুলতানশাহীর অধীনে চাকরি করতেন তিনি। সেসময় তিনি প্রচণ্ড প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। রাজ্যের সুরক্ষা ও শাসনের নেপথ্যে তিনিই হয়ে ওঠেন প্রধান শক্তি। মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দক্ষিণ ভারত জয় রুখতে তিনি প্রথম প্রকৃত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বহুকাল তার সামরিক তৎপরতার কারণেই মুঘল বাহিনী আহমেদনগর রাজ্য জয় করতে ব্যর্থ হয়।

শুধু সুযোগ্য সমর নায়ক নন, অত্যন্ত বুদ্ধিমান কূটনৈতিক, রাজনৈতিক কৌশলের নিপুণ উদ্ভাবক এবং যোগ্য প্রশাসক হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল আম্বরের। ১৫৯০ সালে বিজাপুর রাজ্যের অধীনস্ততা অস্বীকার করে আফ্রিকীয় দাস, আরব এবং স্থানীয় দাক্ষিনাত্যের অধিবাসীদের নিয়ে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী গঠন করেন। এই সেনাদের নিয়েই তিনি আহমেদনগর রাজ্যের স্বপক্ষে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন।

উদারমনা আম্বর ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সমাজের বঞ্চিত অংশের নানা বর্ণের মানুষের প্রতি সহানুভুতিশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার করে তিনি সামাজিক বিভেদ ঘোচাতে উদ্যোগী হন, এবং বঞ্চিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের প্রশাসনের নানা স্তরে চাকরি দিতেন।তাকে নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক টিভি সিরিজ তৈরি হয়েছে। 

এই আফ্রিকান শাসকরা ভারত তথা বাংলার সমৃদ্ধির জন্য অনেকখানি দায়ী। তাদের উৎসাহেই ভারতে শিক্ষা, কৃষিখাত এতটা সমৃদ্ধ হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য ও ব্যবসা- বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল তাদের উদ্যোগেই।   

গাজীপুর কথা