ঢাকা,  বুধবার  ২৪ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ঐতিহাসিক বাগানবাড়ি ‘রোজ গার্ডেন’ এর ইতিহাস

প্রকাশিত: ১৩:১৮, ২৪ জুন ২০২১

ঐতিহাসিক বাগানবাড়ি ‘রোজ গার্ডেন’ এর ইতিহাস

নামে গার্ডেন বা বাগান হলেও এটি মূলত পুরান ঢাকার টিকাটুলিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক বাগানবাড়ি। তৎকালীন ভারতবর্ষে অদ্বিতীয় গোলাপ বাগান সমৃদ্ধ বাড়ি হওয়ার কারণেই এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’।

১৯৩০ সালের দিকে ঋষিকেশ দাস এ বাগান তৈরি শুরু করেন। এই বাগানের জন্য তিনি চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মাটিসহ গোলাপের চারা এনে লাগিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই ‘রোজ গার্ডেন’-ই জন্ম নিলো দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
 
রোজ গার্ডেনের শুরুর কথা: ঋষিকেশ দাস ছিলেন ব্রিটিশ আমলের নব্য ধনী ব্যবসায়ী। তবে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসায় ঢাকার খানদানি পরিবারগুলো তেমন পাত্তা দিত না ঋষিকেশ দাসকে। কথিত আছে যে, একবার তিনি জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর বাগানবাড়ি বলধা গার্ডেনের এক জলসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। অপমান সহ্য করতে পারেননি ঋষিকেশ দাস। ফলশ্রুতিতে একই রকম বাগান ও বাড়ি নির্মাণ করে এর প্রতিশোধ নিতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। তার শপথ অনুযায়ী ঋষিকেশ দাস গড়ে তোলেন স্বপ্নের ‘রোজ গার্ডেন’।

প্রায় ২২ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেন ঋষিকেশ দাস। পশ্চিমমুখী ওই দোতলা বাড়ির চারপাশ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা দুর্লভ প্রজাতির গোলাপের বাগানে সাজিয়ে তোলেন তিনি। সেই থেকে এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’। বেহিসাবি জীবনযাপনের কারণে একপর্যায়ে দেউলিয়া হয়ে যান রোজ গার্ডেনের মালিক ঋষিকেশ দাস। তখনও যে ভবনটি সজ্জিতকরণের কাজ অসমাপ্ত ছিল!
 
আওয়ামী লীগের আঁতুড়ঘর: অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনের বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাসভবনে একটি রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতা-কর্মীরা সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি রোজ গার্ডেনের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়। সেদিনের সে সম্মেলনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন, তার নাম দেওয়া হল-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।’

বাড়ির দর্শনীয় স্থাপনা: শ্বেত পাথরের মূর্তি, কৃত্রিম ফোয়ারা, ঝর্ণা, শান বাঁধানো পুকুর ও অনন্য স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ভাস্কর্য– এক রাজকীয় বাগানবাড়ি রোজ গার্ডেন। প্রায় প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয় গার্ডেন প্রাঙ্গণ।

রোজ গার্ডেনের পশ্চিম বাহু এবং উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী অংশে দুটি মূল ফটক আছে। প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই আছে একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ। এখানে মঞ্চের উপর দণ্ডায়মান আছে কয়েকটি সুদৃশ্য নারী মূর্তি। পূর্বাংশের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি আয়তাকার পুকুর। পুকুরের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি একটি করে বাঁধানো পাকা ঘাট আছে। এর পূর্বাংশে আছে পশ্চিমমুখী একটি দোতলা ইমারত। এ ইমারতটির নাম হলো ‘রশিদ মঞ্জিল’। রশিদ মঞ্জিলের প্রতি তলায় মোট ১৩টি ছোট ও বড় আকারের কোঠা আছে। প্রথম তলায় প্রবেশের পর পশ্চিমাংশের বাম দিকে আছে উপরের তলায় যাওয়ার জন্য ঘূর্ণায়মান সিঁড়ি। এ ইমারতের পূর্ব বাহুর বাম পাশে আছে দুই বাহু বিশিষ্ট আর একটি দোতালা ইমারত। ডান পাশে পরবর্তীকালে আরও কিছু ইমারত নির্মিত হয়েছে। বাইরে ও ভেতরের দিকে ইমারতের খিলানের টিমপেনামের রঙ্গিন কাঁচের অলঙ্করণ বেশ আকর্ষণীয়।

মালিকানা পরিবর্তন: ঋষিকেশ দাস ১৯৩৬ সালের দিকে ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। বাড়ির নাম রাখা হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’। কিন্তু ‘রোজ গার্ডেন’ নামটি মানুষের মুখে মুখে রয়েই যায়। কাজী আবদুর রশীদ সেখানে গড়ে তোলেন প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি। আবার কাজী আবদুর রশীদের কাছ থেকে ১৯৬৬ সালে রোজ গার্ডেনের মালিকানা পান তার বড় ভাই কাজী হুমায়ুন বশীর। এর সুবাদে ভবনটি ‘হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়।

১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে ১৯৭০-এ বেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লিমিটেড রোজ গার্ডেন প্যালেসের ইজারা নেয়। ‘হারানো দিন’ নামের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের শুটিং এ বাড়িতে হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯ সালে রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আদালতে মামলা করে ১৯৯৩ সালে মালিকানা স্বত্ব ফিরে পান কাজী আবদুর রশীদের মেজ ছেলে কাজী আবদুর রকীব। এরপর তার স্ত্রী লায়লা রকীব মালিকানা পান ভবনটির। তবে ২০১৮ বাংলাদেশ সরকার এ ভবনটি ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকায় কিনে নেয়।

গাজীপুর কথা

    আরো পড়ুন