ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

রাজশাহীর ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢোপকল

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ২৬ মার্চ ২০২২

রাজশাহীর ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢোপকল

প্রায় ৮৬ বছর আগের কথা। রাজশাহী অঞ্চলে পানযোগ্য পানির খুব অভাব ছিলো। ফলে নোংরা ও জীবাণুযুক্ত পানি পান করার ফলে শহরবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ। দেখা দেয় কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রকম পেটের পীড়া। এসব রোগে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুও ঘটে। তাই রাজশাহীতে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য নগরীরর বিভিন্ন মোড়ে ঢোপকল বসানো হয়। জীবন রক্ষাকারী সেই ঢোপকলগুলো আজ শুধুই ‘ঐতিহ্য’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরীর কয়েকটি পাড়া-মহল্লায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় বিলুপ্তির পথে রাজশাহী ঐতিহ্যবাহী ঢোপকল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য রাজশাহী শহরে প্রসিদ্ধ ছিল ৯৯টি ঢোপকল। বর্তমান সময়ে শহরের রাস্তা সম্প্রসারণ নগরীতে আধুনিকতায় ছোঁয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে কলগুলো। বিভিন্ন কারণে একের পর এক উচ্ছেদে বর্তমানে ঢোপকলের সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ টিতে। 

১৯৩৪-৩৯ সাল পর্যন্ত রায় ডিএন দাশগুপ্ত ছিলেন রাজশাহী পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান। তখন ডায়রিয়া ও কলেরায় রাজশাহীতে অনেকের মৃত্যু হচ্ছিল। এই সংকট সমাধানে চেয়ারম্যান শহরে পাইপলাইনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার কাজে হাত দেন। এতে সহায়তা করে ‘রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি জনকল্যাণমূলক সংগঠন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংগঠনটি রাজশাহীর দানশীল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহায়তার আহ্বান জানায়। সে সময় রাজশাহীর পুঠিয়ার মহারানি ছিলেন হেমন্ত কুমারী। উদ্যোগের কথা শুনে মহারানি একাই দান করেন ৬৫ হাজার টাকা। স্থাপন করা হয় একটি পানি শোধনাগার। এখান থেকে তখনকার ছোট্ট শহরটির মোড়ে মোড়ে পানি পৌঁছে দিতে বিভিন্ন এলাকায় স্থাপন করা হয় ৯৯টি ঢোপকল। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে বিলুপ্ত।

মহারানি হেমন্তকুমারী পানি শোধন কেন্দ্রে পানিকে বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করে পানি থেকে আয়রন ও পানির ক্ষারতা দূর করা হতো। তারপর সেটা সরবরাহ করা হতো সেই ঢোপগুলোতে। তবে সর্বপ্রথমে সেটা পাথরকুঁচির ফিল্টার দিয়ে পানি ফিল্টার করা হতো। এরপর সেটা সিমেন্টের তৈরি মোটা পাইপের সাহায্যে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। প্রতিটি ঢোপকলেই একটি রাফিং ফিল্টার। এতে বালি ও পাথরের স্তর থাকায় সরবরাহ করা পানি আরো পরিশোধিত হয়ে বের হতো এবং গরমের সময় মোটামুটি ঠান্ডাও থাকতো। 

সেই সময় সারাদিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো। মোড়ে মোড়ে ঢোপকলগুলোতে পানি ধরে রাখা হতো। ফলে সারাদিনই পানি পাওয়া যেত। প্রতি দুই মাস পর পর এই ঢোপকলগুলোকে পরিষ্কার করা হতো। এই ঢোপকলের উপরের ঢাকনাটি খোলা যেত। তারপর ভিতরে মানুষ নেমে ব্লিচিং পাউডার ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সেটা পরিষ্কার করতো। প্রতি দুই মাস পরপর প্রত্যেকটি ঢোপকল থেকে পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করা হতো। পরে সেটা পাঠানো হতো পরীক্ষাগারে পানির মান ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্য।

ঢোপকলগুলো লম্বায় প্রায় ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু এবং ব্যাস প্রায় ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো তৈরি করা হতো সিমেন্টের ঢালাই করে। এই ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো একটা প্লাষ্টার করা। যে নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হতো। এর ঢালাই খুবই শক্ত। সহজে কোনো কিছুর ধাক্কায় বা আঘাতে এটা না ভাঙ্গে। তবে এই ঢোপকলগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে বিলুপ্ত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও হেরিটেজ বাংলাদেশ ইতিহাস আর্কাইভসের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান বলেন, রাজশাহী নগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য একসময় প্রসিদ্ধ ছিল এই ঢোপকল। সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুবই অভাব ছিল। এতে কলেরা-আমাশয়সহ পেটের নানান অসুখ ছড়িয়ে পড়েছিল। বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়েছিল। এজন্য ঢোপকলগুলো সবার স্মরণে রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এখন শুধুই রাজশাহীর কালের সাক্ষী ঢোপকল। অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের মতো ঢোপকলগুলোও বিলুপ্তির পথে। নগর উন্নয়ন ও রাস্তা প্রশস্তকরণের কারণে এক এক করে ভেঙে ফেলা হচ্ছে ঢোপকলগুলো। অথচ এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন