ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

‘গাজীপুরে এক পীরের আবির্ভাব ঘটেছে, তিনি নৌকা ধ্বংস করতে চান’

প্রকাশিত: ২০:০৪, ৩ জুন ২০২৩

‘গাজীপুরে এক পীরের আবির্ভাব ঘটেছে, তিনি নৌকা ধ্বংস করতে চান’

সিটি নির্বাচন-পরবর্তী মূল্যায়ন সভায় বক্তব্যরত জাহিদ আহসান রাসেল।

‘সিটি নির্বাচনে আমি নৌকার পক্ষে এবং টেবিল ঘড়ির বিপক্ষে কাজ করায় গত পরশু দিন ১০-১২ জন ঘড়ির সমর্থক আমার বাড়িতে হামলা করেছে। এই ঘটনায় থানায় জিডি করেছি। আমি নৌকার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু বাড়িতে আমার স্ত্রী ও আড়াই বছরের সন্তান রয়েছে। আমি তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।’

শত শত নেতা-কর্মীর সামনে মাইকে কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক উপপ্রকাশনা সম্পাদক রাজু মিয়া। আজ শনিবার সকালে গাজীপুর মহানগরীর বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে গাজীপুর সিটি নির্বাচন-পরবর্তী মূল্যায়ন সভায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাজু মিয়া বলেন, ‘আমার বাড়িতে হামলার ঘটনার পর আমার সন্তান জানতে চায়, “বাবা আমাদের বাড়িতে কারা, কেন হামলা করেছে?”’ ছেলেকে বলেছি, ‘আমি নৌকার পক্ষে কাজ করেছি। তাই তারা আমার বাড়িতে হামলা করেছে।’ ছেলে জানতে চায়, ‘নৌকা তো ভালো বিষয়, তাহলে তারা হামলা করল কেন?’ জবাবে ছেলেকে বলেছি, ‘আমি ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের এমন এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছি, যে গ্রামে এক পীরের (সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম) আবির্ভাব ঘটেছে। সেই পীরের এলাকায় নৌকা থাকতে পারবে না। ওই পীর নৌকা সহ্য করতে পারেন না। তিনি নৌকা ধ্বংস করতে চান। সবাইকে সেই পীরের মুরিদ হতে হবে।’

রাজু মিয়া আরও বলেন, ‘ওই পীর যখন আমাদের সঙ্গে ছিল, তখন আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে তাঁর জন্য কাজ করেছি। এখন তাঁর পক্ষে কাজ না করার কারণে আমাদের শেষ করে দিতে চায়। আমি আজ নেতৃবৃন্দকে বলে যেতে চাই, যদি আমার মৃত্যু হয়, আপনারা মনে রাখবেন, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে একজন ছিল যে নৌকার জন্য জীবন দিয়েছে।’

রাজু মিয়া যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ হাসান রাসেল, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য শামসুন্নাহার ভূঁইয়া, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ও পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান, গাজীপুর সদর মেট্রো থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়াজ উদ্দিন মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আলিমুদ্দিন বুদ্দিন, আব্দুল হাদীস শামীম, আনোয়ার সাদাত প্রমুখ।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর গত ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে গণভবনে ডেকে কথা বলেন। তিনি সবকিছু শুনে নির্বাচনের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান ও দলের বিশ্বাসঘাতকদের চিহ্নিত করে দল পুনর্গঠনের নির্দেশ দেন। তার পর থেকে সিটি নির্বাচন মূল্যায়ন সভা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মহানগরীর কোনাবাড়ী, কাশিমপুর ও বাসন থানা আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন সভা হয়েছে। 

রাজু মিয়া বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে যেসব কেন্দ্র কমিটি করা হয়েছে, সেখানে জনবিচ্ছিন্ন ও কম গুরুত্বপূর্ণ লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কোনো কাজ করেননি। কেন্দ্রে কোনো পোস্টার লাগানো হয়নি, কেন্দ্র কমিটির নেতাদের অনেকবার অনুরোধ করা হলেও কোথাও কোনো নৌকার পোস্টার লাগানো হয়নি। কেউ নৌকার ব্যাজ পায়নি। পরে দেখা গেছে, চিহ্নিত বিএনপি-জামায়াতপন্থী লোকজনকে নৌকার ব্যাজ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের কর্মীরা একটি ব্যাজও পায়নি।

আওয়ামী লীগ নেতা রাজু সাহা বলেন, ‘নির্বাচনে আমরা মন্দির, মসজিদসহ প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রচারণা চালিয়েছি। কিন্তু আমাদের ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দের অসহযোগিতার কারণে আমরা আমাদের কেন্দ্রে সফল হতে পারিনি। আমাদের কেন্দ্রে কখনো নৌকা পরাজিত হয়নি। কিন্তু এবার বিশ্বাসঘাতকদের কারণে আমরা পরাজিত হয়েছি। গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের নামে সুবিধা দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের নাম বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে আর আজ নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে।’

রাজু সাহা আরও বলেন, কেন্দ্র কমিটিগুলো মানুষের কাছে নৌকার পক্ষে কোনো ভোট চায়নি। তারা আঞ্চলিকতা দেখিয়ে বলেছে, নৌকায় ভোট দিলে সিটি করপোরেশন টঙ্গী চলে যাবে। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমার এলাকায় প্রচুর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তাদের ডাকা হয়নি। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী তাদের সঙ্গে বসেনি।’

মহানগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘কাঁঠালগাছ লাগিয়ে আপনারা তেঁতুল খেতে পারেন না। ঘড়ির কোনো এজেন্ট ছিল না, প্রচার ছিল না। আমাদের দলের লোকজন আমাদের ঘাড়ে বসে ঘড়ির নির্বাচন করেছে। তারা নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। ওয়ার্ডের নেতারা রাতের আঁধারে জাহাঙ্গীরের বাসায় গিয়ে টাকা এনেছে। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নেতা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে টাকা এনে সরকারি একটি সংস্থার কাছে ধরা পড়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?’

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান আলী বলেন, ‘বর্তমানে যেসব ওয়ার্ড কমিটি রয়েছে, এর সবই জাহাঙ্গীরের সময় করা হয়েছে। ফলে এসব কমিটির অনেক নেতা আওয়ামী লীগের নাম দিয়ে ঘড়ির পক্ষে নির্বাচন করেছেন। অনেক ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীরা দলের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। কাউন্সিলররা কত ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, আর ওই সব কেন্দ্রে নৌকার ভোট কত পড়েছে? বাকি ভোট কোথায় গেল? আমরা কে কোথায় বিক্রি হয়েছি। এসব বিষয় খুঁজে বের করা দরকার। সামনে জাতীয় নির্বাচন, তাই এসব ওয়ার্ড কমিটি ভেঙে দিয়ে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে আবার কমিটি গঠন করুন।’

মূল্যায়ন সভায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এমন নানা অভিযোগ তুলে বক্তব্য দেন। তাঁদের অনেকেই রাতের আঁধারে বিকাশের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে টাকা আনার, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ করেন। তাঁরা মোবাইল ও বিকাশ নম্বর, হোয়াটসঅ্যাপ এসব যাচাই করার দাবি জানান।

এ সময় আজমত উল্লা খান বলেন, ‘নেত্রী আমাকে নৌকার পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে থানা পর্যায়ে আপনাদের সঙ্গে এই মূল্যায়ন সভা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ওয়ার্ড পর্যায়ে আলোচনা করে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হবে। যেসব মোনাফিক ও মীরজাফরের কারণে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। না হলে আগামী জাতীয় সংসদে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে।’

আজমত আরও বলেন, ‘নির্বাচনের আগে মহানগর আওয়ামী লীগকে সাচ্চা আওয়ামী লীগ দিয়ে পুনর্গঠন করা হবে। এখানে অনেকে বক্তব্য রেখেছেন। আমি আপনাদের ব্যাপারে সবকিছু জানি। বিভিন্ন সংস্থার কাছে তাদের তথ্য রয়েছে। আপনাদের অনেকের বিকাশ নম্বর আমার ও অন্য নেতৃবৃন্দের কাছে আছে। আপনারা আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছেন, আমার কোনো অভিযোগ নাই। কিন্তু দয়া করে আমাদের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কষ্ট দেবেন না, তাঁর সঙ্গে বেইমানি করবেন না।’

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘গত নির্বাচনে আমরা কতিপয় মোনাফিক ও বেইমানের কারণে হেরে গেছি। মোনাফিক হলো তারা যারা মুখে বলে একটা আর অন্তরে করে আরেকটা। এরা সবার জন্য ক্ষতিকর। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করতে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, যারা নৌকার সঙ্গে বেইমানি করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’