ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কি ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

প্রকাশিত: ১২:২১, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কি ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কি ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে দেশে চলছে তোলপাড়। ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। আলেম সমাজ মনে করছেন, বিবর্তনবাদ  তত্ত্বটি  ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কথা হচ্ছে, কোরআন হাদিসের কোথায় এই তত্ত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে? এটা একেবারেই সাম্প্রতিক চিন্তা। এর পক্ষে বিপক্ষে কোরআন হাদিসে কোথাও স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। বিবর্তনের পক্ষে বরং কোরআনের বেশ কিছু আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে। (সুরা নুহ, আয়াত ১৪)

পর্যায়ক্রমের ব্যাখ্যায় ইমাম তবারি তার তাফসিরে বলেন, অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টির ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা এক অবস্থার পর আরেক অবস্থায় উন্নীত করেছেন। এই বিভিন্ন অবস্থার বিবরণে কোনো হাদিসের উদ্ধৃতি নেই। কোরআনের অন্যত্র বীর্য রক্ত অস্থি মাংস গঠনের স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোকেই ইমাম তবারি এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এনেছেন। পরবর্তী সব তাফসিরবিদ তবারিকেই অনুসরণ করেছেন। আধুনিক সময়ে যেসব ইসলামিক স্কলার বিবর্তন তত্ত্বকে ইসলামের অনূকুল মনে করেন, তারা এই আয়াত থেকে দলিল দেয়ার চেষ্টা করেন। এছাড়া আরো ব‌হু আয়াত থেকে হাজার বছর আগের মুসলিম মনীষীরা বিবর্তন তত্ত্ব হাজির করেছেন। ইবনে খালদুনের মতো মনীষীও মানব সৃষ্টির আলোচনায় বিবর্তন তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। আব্বাসি খেলাফতের সময়ে ইখ‌ওয়ানুসসাফার মুতাযিলা দার্শনিকরা স্পষ্টভাবে মানুষের বানর থেকে বিবর্তিত হবার কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের‌ও আগে বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক ও বিদগ্ধ মুসলিম পণ্ডিত ইমাম জাহিয‌ এই তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন।

বর্তমান সময়ের বাঙালি আলেমরা কেন এই তত্ত্বের বিরোধিতা করছেন? মূলত তারা বিবর্তনবাদকে মানবজাতির জন্য মানহানিকর মনে করছেন। কিছু বিবর্তন বা পরিবর্তন সব আলেম‌ই স্বীকার করেন। তাফসিরের কিতাব সমূহে এই কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত আদম আ. ষাট হাত দীর্ঘ আকৃতির ছিলেন। হযরত নুহ আ. সহস্রাধিক বছর বয়স পেয়েছিলেন সে কথা তো পবিত্র কোরআনেই আছে। এছাড়া সহি হাদিসে আগের যুগের মানুষের দীর্ঘ জীবন ও দীর্ঘ আকৃতির কথা উল্লেখ রয়েছে। আদ ও সামুদ জাতির আকৃতি ছিল বিশাল। এসব কথা সর্বজনবিদিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদেরকে খুব সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে।’ (সুরা বানি ইসরাইল, আয়াত ৮৫)। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানব সৃষ্টির সব তথ্য আল্লাহ আমাদের জানাননি। মানুষ সৃষ্টির সমস্ত পর্যায় পবিত্র কোরআনে থাকা আবশ্যক নয়। মানব সৃষ্টির সামান্য বিবরণই বিবৃত হয়েছে কোরআনে। 

একটা কথা সব স্কলার‌ই বলেন, বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সাথে কোরআন হাদিসের সংঘর্ষ হতে পারে না। মানুষের বর্তমান আকৃতি লাভের পূর্বে অন্য কোনো আকৃতির তত্ত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কাজেই এই তত্ত্ব মানতে নারাজ আমাদের আলেমরা। কথা হচ্ছে আধুনিক অনেক বিষয় ই বাঙালি আলেমরা শুরুতে মানতে রাজি হননি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বলে। প্রথম যখন চশমা আবিষ্কার হলো তখন আমাদের দেশের বড় বড় মাদরাসার ফতোয়া বিভাগ থেকে এটা চোখে দিয়ে নামাজ আদায় হারাম ফতোয়া দেয়া হয়েছে। দারুল ইফতা থেকে বলা হয়েছে, মুসলমানদের নামাজ নষ্ট করার জন্য ইহুদি খ্রিস্টানরা এই চশমা আবিষ্কার করেছে। মাইক আবিষ্কার হবার পর মাইকে আজান দেয়া নাজায়েজ ফতোয়া দেয়া হয়েছে। এখন মাইকের সাউন্ড কমানোর কথা তুললে উল্টো তারা বলেন, আজানের আওয়াজ ভালো লাগে না? ইসলামের মহব্বত নেই তাই মাইকে আজান দেয়ার বিরোধিতা করা হয়। এমন অনেক বিষয়েই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই বিবর্তন তত্ত্বকে ইসলাম বিরুদ্ধ বলার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা ঠিক মনে হয় না।

মানুষের আকৃতি একসময় বানরের মতো ছিল, একথা বললে মানুষকে অসম্মান করা হয় বলে আমাদের একশ্রেণির আলেম উচ্চকিত হচ্ছেন। কিন্তু মানুষ দুর্গন্ধ বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে একথা তো কোরআনেই আছে। মাটি থেকে সৃষ্টি হবার কথাও আছে কোরআনে। আঠালো কাদা মাটি থেকে মানুষের সৃষ্টি। আর এ জন্যই ইবলিস আদমকে সেজদা করেনি। ইবলিসের চিন্তা ছিল, কোনো সৃষ্টির মূল সম্মানজনক না হলে সে নীচ হয়েই থাকবে। আদম যেহেতু মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে তাই সে হীন। আল্লাহ তাআলা ইবলিসের এই দর্শন পছন্দ করেননি। যারা মানুষের বিবর্তনকে অস্বীকার করছেন, তারা ইবলিসের যুক্তিকেই কি ঠিক মনে করছেন?

মানুষ বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে বীর্য নিয়ে মুসলিম ফিকাহবিদদের মাঝে বিরাট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বীর্য পাক, না নাপাক এই নিয়ে হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহে দীর্ঘ আলোচনা আছে। ইমাম শাফেয়ি বলেন, যেই বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে, নবী রাসুল সৃষ্টি হয়েছেন, সেই বীর্যকে কোনোভাবেই অপবিত্র বলা যায় না। ইমাম আবু হানিফা বলেন, হাদিসে স্পষ্টভাবেই বীর্য অপবিত্র হবার বিষয়টি আছে, কাজেই কেবল আবেগ দিয়ে এই মাস‌আলা পরিবর্তন করা যাবে না। বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি একারণে যদি বীর্য পবিত্র হয় তাহলে রক্তকেও পবিত্র বলতে হবে। কারণ বীর্য থেকে প্রথমে রক্ত হয় তারপর অস্থি ও মাংস তৈরি হয়। এক‌ই যুক্তিতে মল-মুত্রকে পবিত্র বলতে হবে। কারণ এর মূল বস্তু পবিত্র খাদ্য ও পানীয়।

মূলত কোন অবস্থা থেকে উদ্ভব হয়েছে সেটি মুখ্য নয়। এখন কোন অবস্থায় আছে সেটা দেখতে হবে। ইসলামি ফিকহের একটা মূলনীতি হচ্ছে, বস্তুর মূল হাকিকত ও প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলে তার বিধান বদলে যাবে। যথা একটা গাধা যদি লবণের খনিতে পড়ে গিয়ে লবণে রূপান্তরিত হয়ে যায় তাহলে তা পবিত্র হয়ে যাবে, অথচ গাধার গোশত খাওয়া ইসলামি শরিয়তে বৈধ নয়। এক‌ই কথা বীর্য ও রক্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানুষ বীর্য ও রক্ত থেকে সৃষ্টি হলেও এখন সে কিছু নষ্ট বীর্য বা রক্তের দলা নয়। এখন সে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কোনো কালে মানুষ অন্য কোনো প্রাণীর আকৃতিতে থাকলেও এখন তো তার সেই আকৃতি নেই। এখন সে শ্রেষ্ঠ আকৃতির প্রাণী। এককথায় বিবর্তন তত্ত্বের সাথে ইসলামি চেতনার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে ইসলামী আকিদা অনুসারে এই বিবর্তন আল্লাহর হুকুমে হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে হবে। একজন আস্তিকের সাথে একজন নাস্তিকের এখানে দ্বন্দ্ব হতে পারে। এছাড়া মূল বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ দেখানো কোনো জ্ঞানের কথা হতে পারে না।

লেখক-ইসলামি চিন্তাবিদ।