ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

কোমল পানীয় এবং প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ

পিয়ারা বেগম

প্রকাশিত: ২২:০০, ১৮ জুলাই ২০২২

কোমল পানীয় এবং প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ

ফাইল ফটো

পানির অপর নাম জীবন। জানা কথাই স্মরণ করছি এই জন্যে যে, আমরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি এই সত্য কথাটা। তাই তো বিয়ে, পিকনিকে, ভ্রমণে, অফিস পার্টিতে, পথে-ঘাটে পারিবারিক বা যেকোনো অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্রান্ডের কোমল পানীয় হরদম খেয়ে যাচ্ছি। এর সঙ্গে  যুক্ত হচ্ছে এনার্জি ড্রিংকস। কোন কোন অনুষ্ঠানে নরমাল পানির ব্যবহার একেবারেই উপেক্ষিত থাকে। কারণ, এটাকেও আমরা সামাজিক স্ট্যাটাস নিরূপণের মাপকাঠি মনে করছি। প্রতিনিয়ত চমকপ্রদ, লোভনীয় এবং চটকদার বিজ্ঞাপনের বদৌলতে চলছে কোমল পানীয়ের রমরমা প্রচার-প্রচারণা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও তাদের নিত্যনতুন বিক্রয় কৌশলের মাধ্যমে  মানুষদের আকৃষ্ট করছে। ফলে বিজ্ঞাপনের হুজুগে ক্রয়-বিক্রি হচ্ছে দেদারসে।  

এবার জেনে নিই, কী আছে এতে আর মানব দেহের ওপর এর প্রভাবেই- বা কতটুকু? 

কোমল পানীয়ে এন্টি ফ্রিজার হিসাবে মেশানো হয় একটি রাসায়নিক উপাদান। যার নাম ইথিলন গ্রাইকল। ফলে ফ্রিজে দীর্ঘক্ষণ রাখলেও তা বরফ হয় না। এটি  মানবদেহের জন্য স্বল্প মাত্রার আর্সেনিকের মতোই একটি বিষ। ইহা স্বচ্ছ ও বর্ণহীন। গবেষকদের মতে, ইথিলিন গ্লাইকল মানবদেহে নীরব বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, হৃদপিণ্ড, লিভার এবং কিডনি জটিলতা এমন কি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বৈকল্য পর্যন্ত ঘটাতে পারে এই ইথিলিন গ্লাইকল। 

 এবার জেনে নিই কেন মানুষ কোমল পানীয়ের প্রতি এতটা আসক্ত? 

 কোমল পানীয়ের প্রতি আসক্তির প্রধান কারণ এর অত্যধিক ক্যাফেইন। তাই এগুলো একবার খেলে বার বার খেতে মন চায়। উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন মূলত কাজ করে আসক্তিকর মাদকের মতোই। এটিও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে তোলে। ফলে স্নায়ুবিক দুর্বলতা, অনিদ্রা এবং হৃৎস্পন্দনের স্বাভাবিক গতিকে বাড়িয়ে দেয়। 

এবার জেনে নিই কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। 

 কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমাদের দেশের বিশিষ্ট কিডনি ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার সিরাজ জিন্নাত ১৯৯৪ সালের বিশেষ ডায়াবেটিস দিবসের আলোচনা সভায় বলেছেন, কোমল পানীয় কিডনি ও মূত্রাশয়ের জন্যে অনেক জটিল রোগ ব্যাধির সৃষ্টির কারণ হতে পারে। কারণ, এ পানীয়ের মধ্যে নেশা রয়েছে। ২০০০ সালের পেন্ডারগ্রাস্ট কোকাকলাসহ অন্যান্য কোমল পানীয়ের অনেক অজানা দিক উন্মোচন করে বলেন, কোকাকলার ফর্মুলায় অ্যালকোহলের উপস্থিতি রয়েছে। তার ভাষায়, শিশুরাও মদ খাচ্ছে, কারণ মা-বাবা তাদের হাতে কোকের গ্লাস তুলে দিচ্ছেন।

২০০৯ সালের ১৪  নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে আয়োজিত একটি সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের মধ্যেও ডায়াবেটিস ও কিডনি জটিলতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, তার অন্যতম কারণ হলো কোমল পানীয়ের প্রতি ক্রমবর্ধমান আসক্তি। তাই যে সব মা-বাবা তাদের আদরের সন্তানটির বায়না রাখতে কোমল পানীয় কিনে দিচ্ছেন, তিনি আসলে সন্তানের অকাল মৃত্যুকেই ডেকে আনছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ধারণা, বিশ্বজুড়ে গত কয়েক দশকে সববয়সী বিশেষত শিশুদের মধ্যে কিডনি রোগ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই কোমল পানীয়। 

প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি ২০১৩,  এনার্জি ড্রিংকস ও এদের ক্ষতিকর দিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির এনার্জি ড্রিংকসের নমুনা সংগ্রহ করে। তা কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। দেখা গেছে, এসব পানীয়ে এমন সব উপাদান রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকীর কারণ। বাজারে প্রচলিত সাত ধরনের এনার্জি ড্রিংকসে উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন এবং অপিয়েট ও সিলডেনাফিল সাইট্রেট পাওয়া গেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রচলিত পানীয়গুলোতে প্রতিলিটারে ক্যাফেইনের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৫০ মিগ্রা, সেখানে আমাদের দেশের পানীয়গুলোতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচগুণ, এমন কী কোন কোনাটাতে তারও বেশি পরিমাণ ক্যাফেইন পাওয়া গেছে। এছাড়াও এসব কার্বোনেটেড পানীয়ে ব্যবহৃত হয় সিনথেটিক ক্যাফেইন, যা আরো ভয়াবহ। মূলত অপিয়েট ও অতিরিক্ত ক্যাফেইন মানুষকে ধীরেধীরে কড়া নেশার জগতে ধাবিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এসব পানীয়ের নেশাকে আরো বড় নেশার জগতে প্রবেশের জন্যে 'ওয়েটিং রুম' হিসাবে উল্লেখ করেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে বাজারে প্রচলিত কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকসসহ সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত ও বোতলজাত জুস সবই আসলে কমবেশি একই উপাদান দিয়ে তৈরি। এসব পানীয়তে বর্ণ ও ফ্লেভার ও প্রিজারভেটিভ হিসাবে  যা ব্যবহৃত হয়, তা অধিকাংশই মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর ও নীরব ঘাতক।

আসুন হুজুগে বিশ্বাসী না হয়ে স্বাস্থ্য সচেতন হই। তথাকথিত বিভিন্ন কোম্পানির মনমাতানো ও লোভনীয় বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হওয়া থেকে বিরত থাকি। যেহেতু স্বাস্থ্য আমার তাই একে সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমার। তাই এই স্লোগান উদ্বুদ্ধ হই। বিশেষজ্ঞদের  মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এর প্রতি গুরুত্ব দিই। এসব ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ   কৃত্রিম ও প্রক্রিয়াজাত পানীয় ব্যবহার করা থেকে মুক্ত থাকি। আসলে কোমল পানীয় নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাধারণ বিশুদ্ধ পানিই যথেষ্ট। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক পিয়ারা বেগম

আরো পড়ুন