ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

`তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না`

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৫ অক্টোবর ২০২১

`তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না`

সম্প্রতি কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার কথিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা সুনামগঞ্জের শাল্লা, কক্সবাজারের রামুতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা পুনরাবৃত্তির চেষ্টা- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পূজামণ্ডপে আক্রমণ ও ভাঙচুরের ঘটনায় এর মোটিভ পরিস্কার। এ ঘটনার আইনি প্রতিকার চাওয়ার আগেই একটি গোষ্ঠী কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালিয়ে ধর্মীয় উস্কানি প্রদান এবং প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা সংখ্যালঘুবিদ্বেষী ধারাবাহিক অপতৎপরতাকারীদেরই কাজ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলামের নামে যারা বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অপকর্ম চালিয়ে আসছে, তারা কি ইসলামের সহনশীলতা সম্পর্কে অবগত নয়? মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, 'হে মানব জাতি, ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কেননা, অতীতে অনেক জাতি এ বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব হবে আমার এ কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।' মহানবীর (সা.) এ ভাষণের মর্মবাণী যারা অনুধাবন করতে জানে না, তারা কোন ইসলামের অনুসারী? ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য প্রদানকারী অনেকে ইসলামের সহনশীলতা এবং নবী মুহাম্মদের (সা.) মানবিক গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের অনুসারী হয়েছিলেন, সে ধরনের অনেক উদাহরণ আছে। ধর্মীয় হিংসা ছড়ানো স্বার্থান্বেষী মহলও এ সম্পর্কে অবগত। এর পরও তারা এ ঘটনাকে পুঁজি করে গুজব ছড়িয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চায় রাজনৈতিক কারণে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে জল ঘোলা করার চেষ্টা অব্যাহত। বিবিসির খবর অনুযায়ী, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বর থেকে খুব ভোরবেলা প্রশাসনের কাছে নানুয়ারদীঘি পূজামণ্ডপের ভেতরে প্রতিমার পায়ের কাছে একটি কোরআন রাখা আছে বলে খবর আসে। প্রশ্ন হলো- এত ভোরবেলা মুসলিম কেউ পূজামণ্ডপে যাওয়ার কথা নয়। তাহলে এত উৎসাহ নিয়ে এ খবর পুলিশকে দিল কারা? আর হিন্দু জনগোষ্ঠীর কেউ এ ধরনের খবর প্রশাসনের কাছে দেওয়ার কথা নয়। অন্য একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুব জরুরি- এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে লাইভে কোরআন অবমাননার বক্তব্য প্রচার করে উস্কানি প্রদানই বা করছিল কারা? দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের বরাতে চারজন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে বিবিসি।
কথিত কোরআন অবমাননার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ জড়িত থাকার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের এই দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও মাথায় এমন দুর্মতি আসতে পারার কথা নয়। এ ঘটনা কোনোভাবেই তাদের জন্য সুখকর হবে না- তা বুঝতে পারার মতো সাধারণ জ্ঞান যে কারোই থাকার কথা। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায়- হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ এমন ঘটনা ঘটিয়েছে; তবে নিশ্চিতভাবে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কেননা, বাংলাদেশের সব হিন্দু নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী নয়। এ গোষ্ঠী ভালোভাবেই জানে, এ দেশ ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারের উর্বর ক্ষেত্র। অতীতে এ ধরনের ঘটনার বহু নজির রয়েছে। '৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে অথবা জিম্মি হিসেবে দেখার প্রবণতার বহু নজির রয়েছে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এমন সব বিধান যুক্ত করা হয়েছিল যে, হিন্দুরা পাকিস্তানের নাগরিক কিনা- সে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদে মহানবীর (সা.) চুল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা; ১৯৭১ সালে ভারতের দালাল আখ্যায়িত করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার-আলবদরের লুটপাট গানিমাতের মাল হিসেবে হিন্দু নারী ধর্ষণের ঘটনা জাতি ভুলে যায়নি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় বাংলাদেশি হিন্দু নাগরিকরা কী দোষ করেছিল? তখন সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর প্রতিহিংসামূলক আক্রমণ কেন হয়েছিল? তারা কি বাংলাদেশের নাগরিক নয়? ২০০১ সালে বিপুল আসনে জয়লাভ করেও হিন্দুদের ওপর নারকীয় হামলা চালিয়েছিল তৎকালীন বিজয়ী দল। এসব ঘটনা দৃশ্যমান হয়, যে কোনো অজুহাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং আক্রমণ চালানো একটি গোষ্ঠীর অধিকারের পর্যায়ে চলে গেছে।
পূর্ব বাংলা যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মিলনকেন্দ্র। এখানে অধিকাংশ মানুষ অসাম্প্রদায়িক মননের অধিকারী। এখানকার ভূগোল, এখানকার বেঁচে থাকার উপকরণের উৎস সবকিছু মানুষকে একটি আবশ্যিক ঐক্যের বাঁধনে বেঁধেছে। কিন্তু একটি গোষ্ঠী সব সময় বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখানোর চেষ্টায় রত।
প্রতি বছর পূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে একটি শঙ্কা নিয়ে উৎসব পালন করতে হয়। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টানের সম্মিলিত রক্তস্রোতধারায় সিক্ত এ দেশের মাটি। সবার সম্মিলিত আত্মত্যাগে স্বাধীন এ দেশ। এ দেশের মানুষ হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে নয়; বাঙালি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত। এ দেশের মানুষের মূল দর্শন হলো- বাঁচো এবং বাঁচতে দাও। মুসলিম-অমুসলিম প্রশ্ন আসে কেন? আর মহান আল্লাহ যার রক্ষাকর্তা, সেই পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কোরআন এত ঠুনকো নয়, যে কেউ চাইলেই এর অবমাননা হয়ে যাবে। এ ছাড়া রাষ্ট্র ও সংবিধান সব ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষকে সুরক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কুমিল্লার ঘটনায় জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট হয়েছে। এ ঘটনা প্রমাণ করে- শাল্লা কিংবা রামুর ঘটনায় আমরা শিক্ষা নিইনি। কুমিল্লার ঘটনার সাইবার প্রচারণা রোধে ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা প্রশাসনের তরফ থেকে আমরা লক্ষ্য করিনি। একটা-দুইটা পোস্ট যখনই আসছিল, ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনা যেত। অপরাধীরা সাইবার ক্রাইম যেমন সহজে করতে পারছে, তেমনি প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা অতটা কঠিন না।
আমরা আশা করব, কুমিল্লার ঘটনাই যেন সাম্প্রদায়িক হিংসার শেষ ঘটনা হয়। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে পাকিস্তানি চেতনার উপস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিজয়া দশমীকে কেন্দ্র করে কোনো গোষ্ঠী যেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না ছড়াতে পারে, সেদিকে সংশ্নিষ্ট সবার তীক্ষষ্ট নজরদারি প্রয়োজন।
সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন