ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

শহীদ ময়েজউদ্দিন: একজন কীর্তিমান পুরুষ

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

শহীদ ময়েজউদ্দিন: একজন কীর্তিমান পুরুষ

শহীদ ময়েজউদ্দিন: একজন কীর্তিমান পুরুষ

১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শহীদ ময়েজউদ্দিনের জন্ম। পিতা মো. ছুরত আলী এলাকায় ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে সুপরিচিত। মাতা-শহরবানু গৃহিণী। বাবা-মার চার ছেলের মধ্যে মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন জ্যেষ্ঠ। প্রথমে নোয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে চুপাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে করে চুপাইর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে কালীগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে বিএ (অনার্স) সম্মান ও ১৯৫৫ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সরকারি চাকরিতে যোগ না দেয়া তার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে একটি। আইন পেশার প্রতি তার অদম্য আকর্ষণ ও অনুরাগের কারণে পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই একজন খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

রাজনৈতিক জীবন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই ময়েজউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি অপশক্তির ভাষা-দাসত্ব চাপিয়ে দেয়ার প্রতিরোধে ১৯৪৮ সাল থেকেই রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার দামাল সন্তানরা। সর্বস্তরের আন্দোলনকে বেগবান করতে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারাগার থেকে তার অবিচল ও দৃপ্ত দিক নির্দেশনা জনতার আন্দোলনে এনেছিল গতিময় উদ্দীপনা। সেই দুর্বার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শাসক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষা শহীদগণ। তখন রাজপথে অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে যারা এগিয়ে এসেছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন তাদেরই একজন। তখনই তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৬২-৬৩ সালে শহীদ ময়েজউদ্দিন ঢাকা পৌরসভার অধীনে কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমে মৌলিক গণতন্ত্রী (বেসিক ডেমোক্র্যাট) মেম্বার মনোনীত হন। পরে তিনি এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগ ও উহার অঙ্গসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপক সহযোগিতা করেন।

১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আইয়ুব মোনেম চক্র বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্দ করে দেয়ার চক্রান্ত করে। সে সময় আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী জেলে। তখন শহীদ ময়েজউদ্দিন দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছেন- ছয় দফার প্রচার চালান, ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’ এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। সেই তহবিলের অর্থ দ্বারাই আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের আইনি সহায়তা দানের প্রধান কাজ পরিচালিত হয়- যা সেই সময় অপরিহার্য ছিল।

শহীদ ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রধান অবস্থানে এসে পাকিস্তানি দখলকার বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে আপস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে এসে সবকিছু ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল। খন্দকার মোশতাক দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভার আয়োজন করেন কলকাতার থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় ভবনের ছাদে। সেই সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ভোটাভুটির জন্য ডিভিশন চাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল।

তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সত্তরের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেন- ‘কোন ডিভিশন নয়, কিসের ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোনো মূল্যে দলের অবস্থান যা আছে তা-ই থাকবে, কোনো নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই উঠে না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনিচক্র খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। এরপর মোশতাক সংসদ সদস্যদের সভা ডেকে ঘাতকদের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেই সভায়ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন সবাইকে হতবাক করে চিৎকার করে বলেছিলেন- ‘খন্দকার মোশতাক আহম্মেদ অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তার কোনো নেতৃত্ব মানি না, সে খুনি, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামী লীগ তার কোনো নেতৃত্ব মানতে পারে না।’

কারাগারে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। দলের এই চরম সংকটময় দিনগুলোতে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার দুরূহ দায়িত্ব পালন করেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। ময়েজউদ্দিনের এই ভ‚মিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তোফায়েল আহমেদ স্বাধীনতা উত্তর পূর্ববাংলার রাজনীতিতে শহীদ ময়েজউদ্দিনের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন ‘২১ শে ফেব্রæয়ারি (১৯৬৯) বিকেলে পল্টন ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় আমরা ঘোষণা করলাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। অন্যথায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনব। পরের দিন ২২ শে ফেব্রুয়ারি তাকে মুক্তি দেয়া হল। আমরা তার পরের দিন ২৩ শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে রমনা রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গণ-সংবর্ধনা দিলাম। সেই সভার সভাপতি হিসেবে আমি তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করার ঘোষণা দিলাম। সেই সভা আয়োজনের পেছনেও ময়েজউদ্দিন ভাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।’ (প্রাগুক্ত)

এই উত্তাল দিনগুলোতে শহীদ ময়েজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন এবং এক্ষেত্রে বেগম মুজিবের অবদান জাতির কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সমাজসেবক : দেশের শীর্ষস্থানীয় ও স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি সমাজসেবক হিসেবে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফপিএবি-র মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওচচঋ (ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন) সহ ওঙজ-র সদস্য ছিলেন। জবীবড়-র প্রেসিডেন্ট হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। শহীদ ময়েজউদ্দিনের আত্মদান: ধাপে ধাপে শহীদ ময়েজউদ্দিন কালীগঞ্জের রাজনীতিতে অপ্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে বিচরণ শুরু করেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, আপসহীন আদর্শবাদিতা এবং ব্যাপক গণসংযোগ তাকে জীবিত অবস্থায়ই কালীগঞ্জের কিংবদন্তী নেতাতে পরিণত করে। কোনোরূপ লোভ-লালসা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি তাকে আদর্শচ্যুত করতে সক্ষম হয়নি।

১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধীরে ধীরে রাজপথে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অসম সাহসী পতাকাবাহী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাজধানীর রাজপথ থেকে কালীগঞ্জের রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। কালীগঞ্জে সামরিক শাসকের দোসররা ততদিনে উপলব্দি করতে থাকে যে, ময়েজউদ্দিনের উপস্থিতিতে কালীগঞ্জের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কালীগঞ্জের ক্ষমতায় আসার জন্য সামরিক শাসকের সঙ্গে ময়েজউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য ময়েজউদ্দিন নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য সমগ্র দেশব্যাপী ২২ দল আহুত হরতাল চলছে। কালীগঞ্জে ময়েজউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। আর তখনই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেয়া কতিপয় সন্ত্রাসী তার ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। কালীগঞ্জের রাজপথ তার পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের এই হত্যকাণ্ড সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তার এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার হতে থাকে। দেশ-বিদেশে তার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্রনিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ধীরে ধীরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলন অবশেষে সামরিক শাসকের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। গণতন্ত্রের জয় হয়।

শহীদ ময়েজউদ্দিনের মূল্যায়ন: কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যে নিবিড় সম্পর্ক, কালীগঞ্জের মানুষের প্রতি তার সে অগাধ ভালোবাসা ও আস্থা তা তাকে কালীগঞ্জের রাজনীতিতে কিংবদন্তী নেতা ও অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়েজউদ্দিনের অবদানের কথা স্মরণ রেখে ময়েজউদ্দিন কন্যা মেহের আফরোজ চুমকীকে ১৯৯৬ সালে গাজীপুর-নরসিংদী জেলার সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি মনোনীত করেন। পরবর্তীতে নিষ্ঠা, সততা, কর্মদক্ষতা যোগ্যতা ও দূরদর্শিতার কারণে তিনি পর পর তিনবার জনগণের বিপুল সমর্থনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

লেখক- মো. আমজাদ খান: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ ঢাকা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।